সাহেদ করিম থেকে লুপা চৌধুরী , নব্য আওয়ামী লীগের একই চেহারা

সেপ্টেম্বর ১১ ২০২০, ১৪:৪৬

Spread the love

আগমনী ডেস্কঃনবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল জয়ের পর থেকেই দলের বিভিন্ন স্তরে শুরু হয় ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলভারি করার প্রবণতা। কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রী-এমপিরা নিজ বলয় ভারি করতে ‘ফুলের তোড়ায়’ বরণ করে নেন বিএনপি ও জামায়াত-শিবির নেতাদের। যাদের অনেকের বিরুদ্ধে ছিল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী হত্যাসহ নাশকতা ও অবৈধ অস্ত্রের একাধিক মামলা। দল বদল করে আওয়ামী লীগে এসে রাতারাতি পুনর্বাসিত হয়েছেন তারা। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরা এখন জেলা-উপজেলায় চালকের আসনেও বসেছেন। ‘অন্য দল থেকে আওয়ামী লীগে নয়’ দলের হাইকমান্ডের এমন নির্দেশনা থাকলেও তোয়াক্কা করেননি মন্ত্রী-এমপি ও নেতারা। প্রতারণার জাদুকর রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম থেকে অপহরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার লুপা তালুকদার; নব্য আওয়ামী লীগের যেন একই চেহারা।

জানা গেছে, বিএনপি ও জামায়াত-শিবির ছেড়ে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। আর এই অনুপ্রবেশ স্রোতের আকার ধারণ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী চারদলীয় জোটের সহিংস আন্দোলন দমে যাওয়ার পর থেকে। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে এখন বিএনপি-জামায়াত খুঁজে পাওয়া ভার। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এবার টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় পর্যায়ে যেন সবাই আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। যাদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘কাউয়া’ এবং ‘হাইব্রিড’ নামে অভিহিত করে আলোচিত হয়েছিলেন। বর্তমানে বাস্তবতা এমন যে এসব নব্য আওয়ামী লীগারদের দাপটে সারা দেশে মূল স্রোতের আওয়ামী লীগাররাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।

সম্প্রতি রিজেন্ট হাসপাতালে পরীক্ষা ছাড়া করোনাভাইরাসের ভুয়া রিপোর্টসহ সাহেদ করিমের নানা অপকর্মের বিষয়টি উঠে আসে। সাহেদের উত্থান নিয়েও উঠে আসে নানা তথ্য। জানা যায় তার রাজনৈতিক অভিলাষের কথা। একের পর এক প্রতারণায় বহু মানুষকে পথে বসিয়েও বাগিয়ে নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য পদ। এরপর থেকে দিন দিন বেড়েই চলছিল তার ক্ষমতার দাপট। তার ভয়ে রীতিমতো তটস্থ থাকতেন অনেক ভুক্তভোগী। সবার সঙ্গেই সাহেদ প্রধানমন্ত্রীর এডিসি, সাবেক সেনা কর্মকর্তা পরিচয়ে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছিলেন।

জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় একটি পাঁচ তারকা হোটেলের বিপরীতে একটি টেলিভিশনের একজন গণমাধ্যম কর্মী প্রথমে সাহেদকে ব্রেক দেন। পরবর্তীতে আরও দুইজন গণমাধ্যম কর্মী সাহেদকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক নামের নতুন তকমা দিয়ে ঘনঘন টিভি পর্দায় নিয়ে আসেন। সাহেদ হয়ে উঠেন একজন টিভি ব্যক্তিত্ব। প্রায় একই সময় সাহেদ সাবেক সেনা কর্মকর্তা পরিচয়ে ‘বিডি ক্লিক ওয়ান’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানি খুলে হাতিয়ে নেন গ্রাহকদের অন্তত পাঁচ শত কোটি টাকা। কিছুদিন গা ঢাকা দিলেও যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন তার সেই মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে। একপর্যায়ে তাদেরই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী প্রখ্যাত-বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে সেলফি উঠিয়ে নিজের বলয় বাড়াতে থাকেন সাহেদ। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুইজন শীর্ষ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার পর সাহেদ তার দুষ্টু পরিকল্পনার অনেকটাই অর্জন করে বসেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের মাধ্যমেই তার পরিচয় হয় সাবেক এক কূটনীতিকের সঙ্গে। নিজের অতীত অপকর্ম আড়াল করে তার বদৌলতেই বাগিয়ে নেন ২০১৬-১৯ মেয়াদের আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য পদ। একদিকে টকশো ব্যক্তিত্ব অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা।

এদিকে ‌ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে নয় বছরের ছোট শিশু জিনিয়াকে অপহরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া লুপা তালুকদারকে ‘বহুরূপী’ বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্মকর্তারা।

পুলিশের রমনা ডিভিশনের সহকারীউপকমিশনার (এডিসি) মিশু বিশ্বাস বলেন, আমরা লুপার অতীত ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছি। তার অতীত ভালো না। তার বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড রয়েছে। একবার তাকে ট্রিপল মার্ডার কেসে আসামি করা হয়েছিল। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগও ছিল। আমার কাছে মনে হয়েছে, লুপা বহুরূপী। তার আচরণও সে কথা বলে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও সক্রিয় রয়েছেন লুপা তালুকদার। সেখানে তিনি নিজেকে বাংলাদেশ আওয়ামী পেশাজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। অগ্নি টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও শেরশাহ টিভির পরিচালক বলে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া মোহনা টিভি, মাই টিভিসহ কয়েকটি গণমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করার কথাও বলেছেন।

লুপা দাবি করেছেন, তিনি বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য। বাংলাদেশ আওয়ামী পেশাজীবী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

লুপা তালুকদারের ফেসবুক প্রোফাইলে দেখা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে সাইক্লোন প্রস্তুতি প্রোগ্রাম (সিপিপি) পুরস্কার-২০১৯ গ্রহণ করছেন। সরকারি দলের নেতা, সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গেও লুপার ছবি রয়েছে নিজস্ব ফেসবুক পেজে।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, সাংবাদিক পরিচয়ে লুপা বেপরোয়া জীবনযাপন করেন। মোতালেব প্লাজার পেছনে একটি ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। বছরখানেক আগে ওই বাসা থেকে এক ছেলের লাশ উদ্ধার করা হয়। তখন লুপা বলেছিলেন, ছেলে আত্মহত্যা করেছে। এখন পর্যন্ত লুপার চারটি বিয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। ‘প্রেস লেখা’ একটি মোটরসাইকেল ব্যবহার করতেন লুপা। সাংবাদিকদের সংগঠনের অনেক নেতার সঙ্গেও রয়েছে তার সখ্য। এসএসসি পাস করা এই নারী নিজেকে ‘অগ্নি টিভির’ কর্ণধার পরিচয়ে অসংখ্য মানুষের কাছে ‘সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র’ বিক্রি করেও অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি পটুয়াখালীর দুই ব্যক্তির কাছ থেকে তার বিরুদ্ধে ১৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ারও তথ্য পেয়েছে ডিবির তদন্তকারী দল।

জানা গেছে, ২০০৩ সালে পটুয়াখালীর গলাচিপা থানায় লুপা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা হয়। পরে ২০১৩ সালে ওই মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি লুপা ও তার স্বজনরা ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ রেহাই পান।

স্থানীয়রা বলছেন, লুপার বাবা হাবিবুর রহমান ওরফে নান্না মিয়া তালুকদারসহ পরিবারের আরো দুই সদস্য ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মামলা ও অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়টিকে আওয়ামী পরিবারের সদস্য হিসেবে ‘রাজনৈতিক হয়রানি’ দাবি করে তাদের রেহাই পেতে মূল ভূমিকার পালন করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা। এ কাজে প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর সহযোগিতাও পেয়েছেন তারা।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও