জানা গেছে, দেড় বছর ধরে নগরীর ম্যাক্স হাসপাতালে হার্টের অসুস্থতাজনিত কারণে ভর্তি রয়েছেন একসময়ের ধনাঢ্য সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী আব্দুল হাকিম মোল্লা (৭২)। হাসপাতালের বকেয়া বিল বর্তমানে অর্ধকোটিতে এসে দাঁড়ালেও খোঁজ নেই তার পরিবারের। গত প্রায় দুই বছর ধরে পরিবারের এই কর্তার খোঁজও রাখছে না তার পরিবারের কোনো সদস্য। এখন রোগী ও বকেয়া বিল নিয়ে বিপাকে পড়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শেষমেশ আইনের আশ্রয়ও নিয়েছে। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা তাতেও সাড়া দেননি।

জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১২ এপ্রিল আব্দুল হাই মোল্লাকে চট্টগ্রামের মেহেদিবাগ রোডের ম্যাক্স হাসপাতালের এইচডিইউতে ভর্তি করান তার ছেলে শফিকুল ইসলাম শুভ। কিন্তু ভর্তির পর পর থেকে তারা রোগীর খোঁজ নেননি। এদিকে হাসপাতালের বিল এসে ঠেকেছে প্রায় অর্ধকোটিতে। একদিকে বিশাল অংকের বিল, অন্যদিকে রোগী নিয়ে বিপাকে পড়েছে ম্যাক্স হাসপাতাল। বিল ও রোগী হস্তান্তরের ব্যাপারে ছেলে শুভর সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যেতে থাকেন প্রতিবারই।

বর্তমানে ম্যাক্স হাসপাতালের ৮১৩ নম্বর রুমে মানবেতর দিন কাটছে একসময়ের সফল সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী আব্দুল হাই মোল্লার। ম্যাক্স হাসপাতাল ও নার্স, ওয়ার্ডবয়রাই এখন তার আত্মীয়স্বজনের ভূমিকায়।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর স্ট্রান্ড রোডের রশিদ বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় আল হোসাইন শিপিং লাইন নামে রোগীর ছেলে শফিকুল ইসলাম শুভর একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়াও তার সিএন্ডএফ ব্যবসাও রয়েছে।

ম্যাক্স হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আল হোসাইন শিপিং লাইনে গিয়েও আব্দুল হাই মোল্লার ছেলে শুভর দেখা পায়নি হাসপাতালের প্রতিনিধিরা। মালিক শুভর অনুপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার মোঃ ইসমাইল হোসেন গত ৩০ নভেম্বর মালিকের পক্ষ হয়ে ম্যাক্স হাসপাতালকে একটি লিখিত বক্তব্য দেন। যাতে শুভর পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আগামী ১০ দিনের মধ্যে হাসপাতালের সাথে আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁঁছাব। পারিবারিক সমস্যার কারণে আমার কোনো নিজস্ব লোক না থাকায় হাসপাতালে কাউকে উপস্থিত রাখতে পারিনি।’ কিন্তু মাস পার হতে চললেও ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত শফিকুল ইসলাম শুভ কোনো সিদ্ধান্ত ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানতে পারেনি।

মাসের পর মাস রোগী নিয়ে এমন অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে পড়ায় গত ৬ ডিসেম্বর নগরীর চকবাজার থানায় রোগীর ছেলে সফিকুল ইসলাম শুভর নামে একটি অভিযোগ দায়ের করে ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

অভিযোগপত্রে দেখা যায়, মোট ৪৯ লাখ ৭১ হাজার ৮১৭ টাকা বকেয়ার বিপরীতে দেড় বছরে মাত্র ১৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা পরিশোধ করলেও ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও ৩১ লাখ ৮১৭ টাকা বকেয়া রয়েছে।

ম্যাক্স হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) রঞ্জন প্রসাদ দাশগুপ্ত চট্টগ্রাম প্রতিনিধিকে বলেন, ‘এই রোগীটার জন্য খুব মায়া হয়। তিনি তার জীবনের সমস্ত উপার্জন ছেলেমেয়েদের কাছে ভাগ করে দিয়ে বিপদে পড়েছেন। এখন তার পরিবারের সদস্যরাই তাকে দেখতে আসে না। খোঁজখবর নেয় না। আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও হাসপাতালের নাম শুনলে ফোন রেখে দেয়।’

তিনি বলেন, ‘আজ দেড় বছর পর্যন্ত আমরা ম্যাক্স হাসপাতালই তার পরিবার। আমার ওর্য়াড বয়-নার্সরাই এখন তার ছেলে-মেয়ে। ওরাই রোগীকে খাওয়ায়, প্রস্রাব-পায়খানা পরিষ্কার করে। যে কাজগুলো রোগীর পরিবারের করার কথা ছিল, সেগুলো আমরা করছি। এখন আমরা রোগীটাকে পরিবারের কাছেও হস্তান্তর করতে পারছি না। টাকাগুলোও উদ্ধার করতে পারছি না। রোগীর পরিবারের টাকার অভাব নেই। শুধু অনিচ্ছার কারণে তারা এই অসহায় মানুষটাকে কষ্ট দিচ্ছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোগীর পুত্র শফিকুল ইসলাম শুভ চট্টগ্রাম প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আমার জানামতে আমার বাবা চারটা বিয়ে করেছেন। আমি প্রথম পক্ষের একমাত্র সন্তান। চার স্ত্রীর কারও সাথেই তার সম্পর্ক নাই। আমি যেহেতু তার প্রথম স্ত্রীর একমাত্র সন্তান, তাই আমি নিজ দায়িত্বে বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করাই। আমি দায়িত্ব মনে করেই বিপদে পড়েছি। বাকি তিন স্ত্রী এবং তার সন্তানেরা কখনও খবর পর্যন্তও নেয়নি।’

হাসপাতালের বিল ও রোগীর খবর না নেওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি সিএন্ডএফের ব্যবসা করি। তাই আমাকে দেশের এদিক থেকে ওদিক যেতে হয়। ব্যস্ততার জন্য যেতে পারি না। আর বিলটা যেহেতু বড়, আমি হাসপাতালকে বলেছি একসাথে দিতে পারবো না। এখন করোনার জন্য ব্যবসার অবস্থা খারাপ। তাই সব টাকা একসাথে দিতে পারবো না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমিই ওনার একমাত্র অভিভাবক। এমনকি আমার মায়ের সাথেও বাবার ডিভোর্স হয়ে যায়, যখন আমার বয়স তিন বছর। উনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন। তাই তাকে বাকি সন্তানদের মত ফেলে দিতে পারিনি। ওনার সব দায়িত্ব আমার।’

এ বিষয়ে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমিন চট্টগ্রাম প্রতিনিধিকে বলেন, ‘ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। আমি কয়েকবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও রোগীর ছেলে শুভর সাথে কথা বলেছি। কিন্তু রোগীর ছেলে বেশ উগ্র প্রকৃতির। তাকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর বিষয়টা ও হাসপাতালরে পাওনার বিষয়টা মীমাংসা করার অনুরোধ করলেও তাতে কোনো কর্ণপাত করেনি। বরং ওই ছেলে উল্টো আমাকে (ওসি) হাসপাতালের টাকা পরিশোধ করে দিতে পরামর্শ দিয়েছেন। মানবিক দিক থেকে আমি বিষয়টা দেখছি।’