অতুলদের জীবন আর চলে না,বার্মিজ আর রেডিমেটের যুগে হারিয়ে যাচ্ছে মুচিরা, পেশা বদলাচ্ছেন অনেকেই

ভনজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জঃ“জীবন আর চলে না গো ভাই। এ পেশায় ভাত নাই। আগের মত কাম কাইজ নাই। বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম তাতে চাল কিনলে ডাল কিনতে পারি না। মাছ মাংস তো স্বপ্নের মত। অনেকেই এ কাম বাদ দিয়ে অন্য কাম করছে। কোনো রকমে অনেক কষ্টে আমিই চালিয়ে যাচ্ছি।” এমনি করে কথাগুলো বলছিলেন পিতলগঞ্জের মুচি অতুল সরকার। পেশা চলে অনত্র চলে গেছেনে, সঞ্জিবন, রাজন, লিটন, উত্তম সরকার, হরি দাস সহ অসংখ্য মুচি।
রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া এলাকার একটি অংশে প্রতি মঙ্গলবার হাট বসে। এ হাটে আগে রাস্তার দুই পাশে একসঙ্গে শতাধিক মুচিদেরকে কাজ করতে দেখা যেতো। কালের বিবর্তনে এখন আর সেই দৃশ্য চোখে পড়ে না। আর যারা এখনো এ পেশায় আছেন, তারা কষ্টে দিনযাপন করছেন। পাশাপাশি অনেকেই বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
কথা হয় মুচিবাড়ির সঞ্জিবনের (৫০) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই মুচির কাজ করে আসছি। প্রথমে বাবার সঙ্গে কাজ শুরু করি। তার কাছ থেকেই কাজ শিখে আজও এ পেশায় আছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘এক ছেলে ও দুই মেয়েকে অনেক কষ্টে বড় করেছি। সকাল ৯টায় কাজের জন্য বের হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরি। সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ৩০০-৪০০ টাকার মতো পাই। তা দিয়েই সংসারের খাবার, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, চিকিৎসাসহ সবকিছু জোগাড় করতে হয়। অনেকে এই কাজ ছেড়ে দিচ্ছে। যারা এখনো আছে তারা কেউ ভালো নেই। তারা কোনোরকমে বেঁচে আছে।
কথা হয় একই এলাকার জীবনের ছেলে কার্তিকের (২৯) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখন আর আগের মতো কেউ জুতা, স্যান্ডেল সেলাই করে না। আগে শুধু সেলাই না; আমরা জুতা, স্যান্ডেল তৈরিও করতাম। এখন দুই চারটা জুতা, স্যান্ডেল সেলাই-কালি করার কাজ পেলেও কেউ আমাদের দিয়ে তৈরি করায় না। এখন সবাই আধুনিক ডিজাইনের জুতা, স্যান্ডেল পরে। তাই আমাদের এখন আর কদর নেই।’
তিনি বলেন, ‘সারাদিন কাজ করে যে টাকা পাই তা দিয়ে সংসার চালানোই কষ্ট। বাবা-দাদার পেশা, ছাড়তেও পারি না। তাছাড়া ছোটবেলা থেকে এই কাজই শিখেছি। অন্য কোনো কাজ করবো, তাও সম্ভব না।’
মুড়াপাড়ায় চালের আড়তের সামনে প্রতিদিন বসেন রঞ্জন ঋষি (৪৫)। তিনি বলেন, ‘বাব-দাদার পেশা, তাই ছাড়তে পারি না। সারাদিন কাজ করে ৪০০-৫০০ টাকার মতো পাই। ঝড়-বৃষ্টি, গরম বা বেশি শীত পড়লে কাজ হয় না। ছেলেমেয়েদের স্কুলে দিয়েছি। এই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। ভাবছি আমার ছেলেকে এই পেশায় আনবো না। সে পড়াশোনা করে অন্য কোনো পেশায় যাক।’
বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে এখন চাকরি করছেন পরিতোষ। তিনি বলেন, ‘আমার বাব-দাদা এই কাজ করতেন। তাদের অনেক কষ্ট করতে দেখেছি। তাই আমি কিছুদূর পড়াশোনা করে চাকরি করছি। এখন আমরা ভালো আছি। আমার ভাইও অন্য কাজ করেন। আমার সন্তানদের পড়াশোনা করিয়ে অন্য পেশায় কাজ করাবো।’
বেশ কয়েকজন মুচির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগের মতো এ পেশায় এখন কদর নেই। আগে বহু লোক কাজ করলেও এখন বড় জোর ২০-৩০ জনের মতো আছেন। তাও তারা নানা প্রতিকূলতার মধ্যে যুদ্ধ করে পেশাটা ধরে রেখেছেন।
শাহালম (টাইগার) মাস্টার বলেন, “একসময় এলাকায় সারিবদ্ধভাবে মুচি/চর্মকাররা বসে কাজ করতেন। কালের বিবর্তনে এখন সেই দৃশ্য হারিয়ে গেছে। এখন অল্পকিছু চর্মকার এ পেশায় আছেন। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। আসলে পেশাটি বরাবরই অবহেলিত। পেশাটি বাঁচাতে সরকারের সহযোগিতা দরকার।”
প্রাবন্ধিক, লোকসংস্কৃতি ও ইতিহাস গবেষক মীর আব্দুল আলিম বলেন, যুগ যুগ ধরে মুচি/চর্মকার সম্প্রদায়ের লেকেরা রূপগঞ্জের বানিয়াদি, মঙ্গলখালি এলাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। দিন দিন আধুনিকতায় ছোঁয়ায় এ সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের আদি পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। যে কারণে চর্মকারের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, পেশাটা অনেক পুরোনো। এখনো এলাকার বিভিন্ন ব্যস্ততম জায়গায় এ পেশার মানুষগুলো দেখা যায়। তারা যদি কোনো সহযোগিতার জন্য আসেন, তাহলে আমি যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করবো।###