বরিশাল শেবাচিম চিকিৎসককে পরিকল্পিত হত্যার আলামত
শাকিব বিপ্লব, (সহযোগিতায়- হাফিজ স্বাধীন): রহস্যঘেরা মৃত্যুবরণকারী শেবাচিম হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. এম এ আজাদ সজল ঢাকার কেরানীগঞ্জের ইমাম বাড়ি গোরস্থানে শাহিত হয়ে এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিলেও বরিশাল পুলিশের সম্মুখে রেখে গেলেন একটি জিজ্ঞাসাবাধক প্রশ্ন। আদৌতে তার মৃত্যু নিছক কোন দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত হত্যা, তা নিশ্চিত হতে বরিশালের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একাধিক সংস্থা এই রহস্য উম্মোচনে মাঠে নেমেছে বলে জানা গেছে। প্রাথমিকভাবে বিষয়টিকে হত্যা হিসেবে ধরে নিলেও নিশ্চিত হতে পারছে না কিভাবে ঘটলো এই বিয়োগান্ত ঘটনা। মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালের ৯ কর্মচারীকে কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে। সংশ্লিষ্ট থানার ওসি তদন্ত এ.আর মুকুল জানান, এখনও রহস্যের কোন কিনারায় পৌছানো যায়নি। তবে আশাবাদী আজ অথবা কাল ঘটনার নেপথ্যেরদার উম্মোচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পুলিশের ভাষ্য, ২৭ এপ্রিল সোমবার বিকেলে শহরের কালীবাড়ি সড়কে মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালের নিচে নেমে বাজার করে উপরে ওঠার পর থেকে এই চিকিৎসক নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরই তার মৃত্যু ঘটেছে, নাকি গভীর রাতে কোন এক সময় তার জীবন কেড়ে নিয়ে তা আঁড়াল করতেই ওই হাসপাতালের লিফটের নিচে তার রক্ত ভেজা দেহ রাখা হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও হাসপাতাল পরিচালক ডাক্তার জহিরুল হক মানিক মিডিয়ার কাছে তার সহকর্মী এই চিকিৎসকের মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলে দাবি করেছেন। জহিরুল হক মানিকও শেবাচিম হাসপাতালের সার্জারি বিভাগীয় প্রধান এবং স্বনামখ্যাত চিকিৎসক হিসেবে বরিশালে পরিচিত। নিজস্ব মালিকানাধীন মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতাল লাগোয়া ফেয়ার ক্লিনিকের অংশিদার তিনি।
উল্লেখ্য, শেবাচিমের বার্ন ইউটিন প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. সজল মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালে প্রাকটিসের পাশাপাশি সেখানকার সপ্তম তলার ৮ নম্বর কক্ষে বসবাস করতেন। হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট ফার্মেসির কর্মচারী ও নিহত চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে সঙ্গ দেয়া হাসানের দাবি বিকেল ৫টার পর ডা. সজল নিচে নেমে বাজার করে কিছু অংশ তার কাছে দিয়ে একটি টুথপেস্ট ও কিছু পেঁয়াজ নিয়ে ওপর উঠার আগে তার কক্ষে ইফতারি দেয়ার জন্য অনুরোধ রাখেন।
কক্ষে যেতে তিনি লিফটে কখন উঠেছিলেন তা কেউ প্রত্যক্ষ করতে পারেনি এমনটি দাবি করা হচ্ছে। অথচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, লিফটে উঠতে গিয়েই তিনি অসতর্কবসত নিচে পরে মারা যান। প্রশ্ন উঠেছে যদি তাই ঘটে, তবে চিকিৎসকের হাতে থাকা সেই টুটপেষ্ট ও পেঁয়াজের থলে লিফটের ভিতর স্বাভাবিকভাবে পাওয়া গেল কিভাবে? এতে প্রমাণ করে ডা. সজল তার থাকার কক্ষে পৌছাতে পারেনি। তালাবদ্ধ কক্ষ খুলে পুলিশ ও স্বজনরা দেখতে পায় সবকিছুই স্বাভাবিক রয়েছে।
কোন কোন মহল বলছে, সার্বিক আলামতে ধারণা মেলে নিশ্চিত তিনি লিফটের ভিতরেই ছিলেন। সেখান থেকে কে বা কারা তাকে পরিকল্পিতভাবে অপহরণ করে ওই হাসপাতালের ভিতরেই কোন কক্ষে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন। রাতের গভীরতায় কোন এক সময় তাকে হত্যা করা হয়। কারো একার পক্ষে এই ঘটনা সংঘটিত করা সম্ভব নয়। দুই থেকে চারজন ঘটনার সাথে জড়িত থাকতে পারে। লিফটের নিচে লাশ ফেলে রাখাও হয়েছিল পরিকল্পনা মাফিক। সেক্ষেত্রে লিফট নিয়ন্ত্রণকারী ট্যাকনিশয়ান এ বিষয় কম-বেশি অবগত থাকতে পারেন। কারণ লিফট ওপরে উঠে গেলে নিচে বন্ধ দুয়ার খুলতে চাবির প্রয়োজন। সেই চাবি স্বাভাবিক ভাবেই ট্যাকনিশিয়ানের কাছে থাকার কথা। আবার এত বড় একটি ক্লিনিকে রোগীর স্বজনদের আসা যাওয়া এবং কর্মচারীদের ঘোরাঘুরি মাঝে কিভাবে এই ঘটনার সমাপ্তি টানা হলো সেই প্রশ্নটিও সামনে এসেছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যে দুর্ঘটনার কথা দাবি করছে তা সার্বিক বাস্তবতায় এখন ধোপে ঠিকছে না। তবুও পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত হতে সময়ের সাথে গভীরভাবে জোর তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। সমসায়মিককালে বরিশালে একটি হত্যাকান্ড নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তোড়জোর চোঁখে পরার মত। শুধু থানা পুলিশ নয়, গোয়েন্দা টিম ও পিবিআইসহ র্যাবের গোয়েন্দা শাখাও বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কি কারণে এই চিকিৎসক হত্যার পরিণতি বরণ করলেন? এনিয়ে নানা জনের নানা মত পাওয়া গেছে। কেউ বলছে, ছুটি না পাওয়ায় গত দুই মাস যাবত ঢাকাস্থ পরিবারের কাছে যেতে না পারায় উপার্জিত নগদ অর্থ তার কাছেই ছিল। শেবাচিমে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশ মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় নিজ চেম্বারে রোগী দেখার পাশাপাশি প্রতিদিন অপারেশনে অংশ নিতেন। ফলে মোটা অংকের অর্থ তার কাছে থাকার বিষয়টি কেউ অবগত হয়েছিল।
আবার কারো ধারণা, ওই হাসপাতাল অভ্যন্তরে কোন নারী কর্মচারীর সাথে তার সখ্যতা থেকে কারো সাথে শত্রুতা তৈরি হয়েছিল। এই দুইয়ের যেকোন একটিই হতে পারে তাকে হত্যার নেপথ্যের ইস্যূ। পুলিশ এই বিষয়টি দুইটি সামনে রেখেই তদন্তে এগিয়েছে বলে জানা গেছে। মমতা হাসপাতালের ৯ কর্মচারীকে অনানুষ্ঠানিকভাবে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদে কি পাওয়া গেছে তা নিয়ে পুলিশ মুখ খুলছে না, বলছে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। এখনও কোন ক্লু পাওয়া যায়নি।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বিষয়টি দুর্ঘটনা বলা হলেও আসলে তা নয়, তার প্রমাণ বহন করে লাশের দেহের বিভিন্ন অংশে জখমের ধরন দেখে। ময়নাতদন্তকালে সেখানে উপস্থিত ডা. সজলের ছোট ভাই উচ্চ শিক্ষিত যুবক উচ্ছ্বাস এই প্রতিবেদককে জানান, নিহতের ডান পায়ের হাটুর নিচ থেকে হাড় ভেঙে বেড়িয়ে গেছে। বাম পায়ের তালুর নিচে মাংস নেই। বুকের হাড় ভাঙা দেখা খেছে। তার ধারণা লিফটের নিচে রেখে চাপা দিয়ে ঘটনা আঁড়াল করতেই সেখানে ফেলে রাখা হয়েছিল। তারা এই মৃত্যুকে হত্যা বলে মনে করে লাশ উদ্ধারের সময়কাল ২৮ এপ্রিল রাতে কোতয়ালী মডেল থানায় নিহতের ভাই উচ্ছা¦স নিজে বাদি হয়েই একটি সন্ধিদ্ব হত্যা মামলা দায়ের করেছে। মামলায় কারো নাম উল্লেখ না করে আসামীর তালিকায় অজ্ঞাতনামা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
অপর একটি সূত্র বলছে, হাসপাতাল পরিচালক জহিরুল হক মানিকের এক সহদর ঢাকা মেট্রোপুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা, যিনি বরিশাল পুলিশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে, যাতে মমতা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাউকে হয়রাণি করা না হয়। হাসপাতাল পরিচালকের হাবভাবে তেমনটি প্রকাশ পাচ্ছে। অবশ্য পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এ ধরণের বিষয় অবান্তর বলে অস্বীকার করেছেন।
এদিকে নিহত ডা. সজলের লাশ রাত দেড়টায় সড়ক পথে কেরানীগঞ্জে পৌছায়। সেখানকার বন্দডাকপাড়া এলাকায় স্থানীয়ভাবে বসবাসকারী তার পরিবার সজলের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পরে। তার স্ত্রী কহিনুরেরও প্রশ্ন তার স্বামীর ঘাতক কারা? নিহতের চাচা আব্দুল করিম জানান, আজ বুধবার ২৯ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টায় স্থানীয় ইসকট পল্লী জামে মসজিদ সম্মুখে জানাজা শেষে অনতিদূরে ইমাম বাড়ি গোরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।