ভাড়া বাসায় নয় শেষ জীবনে নিজ বাড়িতে মরতে চাই-বীর প্রতীক আয়েজউদ্দিন আহমেদ

মার্চ ২৫ ২০১৮, ২৩:৩৫

Spread the love

নাঈম ইসলাম :
দেশের প্রতি ভালবাসা, দেশের প্রতি টানে ১৯৫৮ সালে তৎকালীন ইপিআর এ যোগদান করি। বাঙালী বলে তখন থেকেই আমরা অবহেলিত। পূর্ব বাংলার মানুষ হয়েও তৎকালিন সময়ে পূর্ব বাংলার জন্য কিছুই করতে পারেনি। তবে সুযোগ এসেছে ১৯৭১ সালে দেশের জন্য কিছু করার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান যখন ১৯৭১ সালের ৫ই মার্চ আমাদের ইউনিট চিটাগং আলী শহরে এসে ইপিআর এর সকল বাহিনী নিয়ে মিটিং করে। এবং দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ প্রদান করে তখন থেকেই দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকি। এরপর রেসকোর্স ময়দানে ৭ই মার্চ যখন বাঙালিদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ প্রদান করে তখন আর বুঝতে বাকি ছিলনা আর দেশের জন্য কিছু করার সুযোগটাও হয়ে গেল। ২৫শে মার্চ রাতে যখন পাকবাহিনী ঢাকার নিরহ মানুষের উপর হামলা চালায় তারি প্রতিরোধে ২৬ শে মার্চ ১ম অপারেশনে নামতে হয়। দেশ রক্ষার জন্য। আমার অফিসার মেজর রফিকুল ইসলাম অপারেশনে যাওয়ার আগে কিছু দিক নির্দেশনা দিল আমাদের টিমকে। তারই নির্দেশে প্রথমেই ্আমাদের পাকিস্তানি নৌবাহিনীর একটি জাহাজে হামলা চালাই। ওদের ঘায়েল করতে পারলেও অবশেষে পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রে পিছু হাটতে হয়েছে আমাদের। মার্চ মাসের শেষের দিকের কালুরঘাটের ২য় অপারেশনটা এখনো চোখের সামনে ভাসছে। যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজের আপন ভাই সহ হারাতে হয়েছে আমাদের ইউনিট এর কয়েক জনকে। কালুরঘাটের মুখমুখি যুদ্ধে পাকবাহিনীদের হারিয়ে দখল করে নেই ওদের এলাকা। দখলের পরে হালী শহরে রেষ্টহাউজে রেষ্ট নিচ্ছি আমরা। হঠাৎ পাকহানাদার বাহিনী হামলা চালায় আমাদের উপর। ওরা আমাদের উপর ফোর রেঞ্জ মটর দিয়ে হামলা চালায় আর আমরা পাল্টা হামলা স্বরূপ থ্রিরেঞ্জ মটর দিয়ে ওদের আক্রমন করি। কিন্তু ওদের মটর আমাদের থেকে অনেক শক্তিশালী হওয়ায় আমরা এদিক ওদিক ছুটে যাই। পরে কর্নফুলী নদী পাড়িয়ে ৭০-৭৫ মাইল দূরে কুবিরা উঠি। নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য শরীরের সমস্ত কাপড় খুলে ফেলি উলঙ্গ অবস্থায় কর্নফুলী নদীতে সাতার কেটে কুবিরা এসে পৌঁছাই। কুবিরা এসে প্রথমে এক বাসায় পড়নের জন্য কাপড় চাইলে তারিয়ে দেয় তারা। এরপর একটি দোকানে গিয়ে দোকানের মালিকের কাছে বলি দাদা আমি যুদ্ধ করতে গিয়ে পাকবাহিনীর হামলায় আমাদের ইউনিট এলামেলো হয়ে যায়। তাই নিজের জীবন বাচাতে আমার এরকম অবস্থা আমাকে একটি কাপড় দিবেন। এটা বলার পরে একটা ছেরা প্যান্ট ও হাফ হাতার একটি গেঞ্জি পেয়েছি। যার দ্বারা কিছুটা সরম ডাকতে পেরেছি। রাতে তাদের বাসায় থেকে,সকালে আবার বেরিয়ে পরি। হাটতে হাটতে চিটাগং এর বড় একটা রাস্তায় উঠি এরপর দেখি অনেকে বাংলাদেশে থেকে ভারতের দিকে যাচ্ছে। আমাকেও নিয়ে নেয় ওরা। গাড়িতে উঠে সুবুপুর ব্রিজ নামি। ওখানে আবার একটা ক্যাম্প করা হয়েছে। ওই ক্যাম্পে আমরা যারা এলোমেলো হয়েছিলাম তারা আবার একত্রিত হই।একত্রিত হওয়ার পরে ইয়াকু বাজারে আমার নেতৃত্বে একটা টিম দেয়া হয়। ইয়াকু বাজারে অবস্থান নেয়ার পরে পাকবাহিনী আমাদের উপর আবার হামলা চালায়। ওদের ভারী অস্ত্রের কাছে আবারো আমাদের পিছু হাটতে হয়েছে। এরপরে আমার ইউনিট নিয়ে রামঘর আসি। সেখানে এসে দেখি আমাদের সব অফিসারা।ওখানে যাওয়ার পওে আমাদের টিমকে হরিণাটিলায় অবস্থান নিতে বলে যা এক নম্বও সেক্টর এর আওয়াতায়। এরপর আমাদের ইউনিট এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে আবার একটা মুখোমুখি যুদ্ধে সম্মূখীন হই। তখন মুখোমুখি যুদ্ধে পাকবাহিনীর গুলি এসে আমার পায় লাগে। এরপর আমি আহত হয়ে পরি। দীর্ঘ একমাস ভারতে চিকিৎসা নেয়ার পরে আবার যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশে আসি। আসার পরে আমাকে টিম প্রধান করে ৮টি থ্রি রেঞ্জ মটর দেয়া হয়। কুমিল্লা উৎমাবিউপি পাকবাহিনী আর্মি ক্যাম্প হামলা চালানোর জন্য।জুন মাসের এই হামলায় পাকবাহিনী আর্মি ক্যাম্পের প্রায় ২০০-২৫০ জন নিহত হয়। সম্পূর্ন ক্যাম্প ধংশ করে দেই। এরপরে অনেক অপারেশনে যেতে হয়। অনেক অপারেশনে ওদেরকে ঘায়েল করে ছিনিয়ে আনি স্বাধীন বাংলাকে। আমার আপন ভাই তাইজুদ্দিন আহমেদ আমার চোখের সামনেই পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। আপন ভাইসহ নয় মাসে হারাতে হয়েছে অনেক আপন মানুষ আর অনেক স্মৃতিকে। বহু ত্যাগ তিতিক্ষার পরে দেশকে স্বাধীন করতে পেরেই সব কষ্ট ভূলে গেছেন বীরপ্রতিক সুবেদার মেজর আয়েজউদ্দিন আহমেদ। সব কষ্টভুলে গেলেও ভালো নেই। নেই কোন স্থায়ী ঠিকানা দেশের এই বীর সন্তানের। ভাড়া বাসায় জীবনের শেষ মূহূর্তে কষ্টে কাটছে বীরপ্রতিকের জীবন। সরকারী ভাতা যা পায় তা দিয়ে কোন রকম সংসার কাটছে তার। ১৯৭১ এর যুদ্ধের পর ১৯৮৪ সনে অবসরে আসেন বীরপ্রতিক। তখন সেনাবাহিনী থেকেও কোন সুযোগ পাননি তিনি। স্থায়ী বাসস্থানের অভাবে ভাড়া বাসায় দিন কাটাচ্ছে স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের বাসস্থানের জন্য জমি বা বাসস্থান বরাদ্ধ হলেও কোন বরাদ্ধ হয়নি তার নামে। দেশের জন্য যা করেছেন তার প্রতিদান দেশ কি দিয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে এ প্রতিবেদককে বলেন, দেশ থেকে কিছু নেবার জন্য তো যুদ্ধ করিনি। দেশটাকে পাকহানাদারদের থাবা থেকে মা-বোনের ইজ্জত রক্ষায় যুদ্ধ করেছি। তবে বর্তমান সরকার শেখ হাসিনার আমলে ভালই আছি। এর আগে তো কেউ খোঁজ ও নেয়নি। কোন দাবী বা শেষ ইচ্ছা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানায়,পায়ে গুলি লেগেছে হাটতে পারিনা। সারাদিন বাসায়ই থাকতে হয়। নিজের নেই কোন স্থায়ী বাসস্থান। সরকারী ভাবে যদি স্থায়ীভাবে বাসস্থানের সুযোগ করে দেয়া হয়। তাহলে জীবনের শেষ সময়টা হয়তো নিজ বাড়ীতে বসে কাটাতে পারতাম। দেশপ্রেম জাগ্রত ও দেশের কল্যানে নতুন প্রজম্মকে কাজ করে এগিয়ে নিবে দেশকে এই প্রত্যাশাই করেন বীরপ্রতিক সুবেদার মেজর আয়েজউদ্দিন আহমেদ।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও