সুবিধা বঞ্চিতের উত্তরণ

অক্টোবর ২১ ২০১৯, ১৯:৩৩

Spread the love

অনলাইন ডেস্কঃদারিদ্র্য দূরীকরণে অবদানের জন্য এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়া এমআইটির অর্থনীতির অধ্যাপক দম্পতি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো ২০০৭ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন মডেল নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। বর্তমানে বিশ্বের ৪০টির বেশি দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্র্যাক প্রণীত এই মডেল বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৫ সালে তাঁদের গবেষণার ওপর একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল বিখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এ। এটি সেই প্রবন্ধের একটি ভাবানুবাদ।

দারিদ্র্য বিমোচনে যত রকম কর্মসূচি দুনিয়ায় আছে, তাতে দেখা গেছে কেবল অল্প কিছু এলাকার, অল্প কিছু মানুষ, অল্প কিছু সময়ের জন্যই উপকৃত হয়। মূল সমস্যাটা হলো এসব কর্মসূচিতে যাঁরা অংশগ্রহণ করেন, শুরুতে তাঁদের অনেকেই দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে আসে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সেই অবস্থাটা তাঁরা ধরে রাখতে পারেন না। বেশির ভাগই কিছুদিন পরে আবার আগের অবস্থায় ফেরত যান। যেমন ধরা যাক ক্ষুদ্রঋণের কথা। এ ধরনের ঋণ নিয়ে শুধু তাঁরাই উন্নতি করতে পারেন, যাঁরা ব্যক্তি হিসেবে উদ্যোগী প্রকৃতির। অতি দরিদ্রদের মধ্যে আবার এ ধরনের উদ্যোগী মানুষের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। একইভাবে শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ বা এ ধরনের প্রকল্পের সাফল্যের জন্য প্রয়োজন কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা। এক দেশে যেটা কাজ করেছে, অন্য দেশে আবার সেটা করেনি। এর মূল কারণ সংস্কৃতি ও পারিপার্শ্বিকতায় ভিন্নতা। এবং অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সবচেয়ে দরিদ্র যারা, তাদের অবস্থার পরিবর্তন আনাটাই সবচেয়ে কঠিন।

সুতরাং, পুরো ছবিটা দেখে আশাহত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এই বাস্তবতায়, অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক দুফলো এবং আরও কয়েকজনের লেখা অন্য আরেকটি নিবন্ধের বিষয়বস্তুকে চমকপ্রদ মনে হতে বাধ্য। তাঁদের দাবি, দারিদ্র্য দূরীকরণের এমন একটি কৌশল তাঁরা বের করেছেন, যা সব জায়গায়, সব ধরনের মানুষের জন্য কাজ করবে। গবেষণাটি করা হয়েছে সাত বছর ধরে, বিশ্বের ৬টি দেশের প্রায় ১০ হাজার দরিদ্র পরিবারের ওপর। এই কৌশলের অংশ হিসেবে, ওই পরিবারগুলোকে প্রথমে কিছু সম্পদ (মূলত গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি) হস্তান্তর করা হয়। এরপর তাদের দেওয়া হয় কিছু নগদ অর্থ সহায়তা। সবশেষে দুবছর ধরে তাঁদের নানা রকম প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ দেওয়া হয় যাতে তাঁরা সেই সম্পদগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন। ঘানা, পাকিস্তান ও পেরুর মতো কয়েকটি দেশে দেখা গেছে যে এই ফর্মুলায় একেবারে হতদরিদ্র মানুষের জীবনে একটা দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

অতি দারিদ্র্য দূর করার এই কৌশলের মূল প্রবক্তা বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। সংস্থাটি এর নাম দিয়েছে ‘গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম’। আগেই বলা হয়েছে যে দরিদ্র মানুষেরা নানাবিধ সমস্যার কারণে এ অবস্থায় পতিত হন। তাই এই কৌশলটির পেছনে যুক্তিটা এ রকম: একটি সমস্যা সমাধান করে, বাকি সমস্যাগুলোকে ফেলে রাখলে কোনো লাভ হবে না। যার শরীরে অনেকগুলো গভীর ক্ষত, তার মাত্র একটিতে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে বাকিগুলোকে ফেলে রাখলে সেগুলোতে পচন ধরবে এটাই স্বাভাবিক। যেমন ধরা যাক হিইফার ইন্টারন্যাশনাল, অক্সফাম বা ওয়ার্ল্ড ভিশনের কথা। এই আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো অনেক উন্নয়নশীল দেশে দরিদ্রদের মাঝে গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি বিতরণ করে, যাতে তারা দুধ বা ডিম বিক্রি করে আয়-উন্নতি করতে পারে। কিন্তু যদি দরিদ্র মানুষগুলো ক্ষুধার জ্বালায় সেই গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি খেয়ে ফেলে, তখন কী হবে?

ব্র্যাকের গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামেও দরিদ্রদের হাঁস-মুরগি দেওয়া হয়েছে। তবে সঙ্গে দেওয়া হয়েছে কিছু নগদ অর্থ সাহায্য, যাতে তাদের প্রথমেই সেই হাঁস-মুরগি খেয়ে ফেলার প্রয়োজন না হয়। পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে হাঁস-মুরগি পালনের ওপর প্রশিক্ষণও। এ বিষয় নিশ্চিত করার জন্য ব্র্যাকের মাঠকর্মীরা বারবার তাঁদের বাড়িতে গেছেন, নিয়মিত তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে চেষ্টা করেছেন। এমআইটির গবেষক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, দুফলো এবং তাঁদের সহযোগীরা, স্থানীয় এনজিওদের সাহায্যে এই মডেল নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছেন ইথিওপিয়া, ঘানা, হন্ডুরাস, ভারত, পাকিস্তান এবং পেরুতে। সব জায়গাতেই অতি দরিদ্রদের এ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়।

এই ছয়টি জায়গাতেই দরিদ্র পরিবারগুলোকে যেকোনো একটি সম্পদ (গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি) বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এটা তাদের দেওয়া হয় এককালীন অনুদান হিসেবে। পাশাপাশি এক বছর ধরে প্রতিদিন এক কেজি চাল কেনার জন্য যে পরিমাণ টাকা প্রয়োজন, তাদের সেটাও দেওয়া হয়। প্রদত্ত সম্পদ ব্যবহার করে কীভাবে আয়রোজগার করা যায়, সে বিষয়ে তো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ই, পাশাপাশি কীভাবে এই প্রাণীগুলোকে সুস্থ রাখা যায়, শেখানো হয় তা-ও। সবশেষে আয়ের একটি অংশ কীভাবে নিরাপদে সঞ্চয় করা যায়, তাদের সেই উপায়ও বাতলে দেওয়া হয়। আর নানাভাবে উৎসাহ দেওয়ার বিষয়টি তো রয়েছেই। অবশ্য দেশভেদে কিছু কিছু ভিন্নতা ছিল। যেমন কোনো কোনো দেশে দেওয়া হয়েছে গরু-ছাগল, কোথাও বা হাঁস-মুরগি। অর্থ সঞ্চয়ের বিষয়টির ওপর কোনো দেশে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে, কোনো দেশে কম। তবে মূল কর্মকৌশলটা সবখানে একই ছিল।

এই পরীক্ষার ফলাফল ছিল আশাব্যঞ্জক। কর্মসূচিগুলোর দুবছরের মেয়াদ শেষে দেখা গেছে, অন্যদের তুলনায় অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোর মাসিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে ৫ শতাংশ। তাদের পারিবারিক আয়ও বেড়েছে। রাতে খালি পেটে ঘুমোতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কমেছে। সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১৫%, যা দেখে বোঝা যায় যে তাদের যে হাঁস-মুরগি দেওয়া হয়েছে সেগুলো তারা খেয়ে ফেলেনি। তারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দৈনিক গড়ে সাড়ে ১৭ মিনিট বেশি কাজ করেছে, মূলত গবাদিপশু বা হাঁস-মুরগি প্রতিপালনে। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়টি হলো: একদম দরিদ্রদের মধ্যেও যারা দরিদ্রতম (অর্থাৎ একেবারে নিচের দিকের ১০% পরিবার), তাদের পারিবারিক ব্যয় ও সম্পদের ব্যবহারের ওপর একটা দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা গেছে।

এই গবেষকেরা যখন কর্মসূচিগুলো শুরু হওয়ার এক বছর পর এই পরিবারগুলোর সদস্যদের সঙ্গে গিয়ে কথা বলেছেন, দেখা গেছে তখনই তাঁরা আগের চেয়ে বেশি সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করছেন, তাঁরা আগের চেয়ে বেশি আয় করছেন এবং খাদ্য গ্রহণের পরিমাণও বেড়েছে। গবেষকেরা তখন বলেছেন যে কর্মসূচিগুলো আরেকটু লম্বা সময়ের জন্য চালু রাখা গেলে বিনিয়োগের তুলনায় অন্তত ১.৩৩ থেকে ৪.৩৩ গুণ বেশি সুফল পাওয়া যেত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বাংলাদেশের কথা যেখানে এ রকমই আরেকটি গবেষণায় টানা তিন বছর ধরে অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম হলো হন্ডুরাস। সেখানে কোনো একটা কারণে হাঁস-মুরগি মরে যাওয়ায় কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যায়নি।

এই পরীক্ষামূলক কর্মসূচিগুলোর পরিচালনা ব্যয় দেখলে চোখ কপালে উঠে যেতে পারে, যেমন ভারতে প্রতি পরিবারের পেছনে খরচ হয়েছে ৪১৪ ডলার এবং পেরুতে ৩ হাজার ১২২ ডলার। তবে এর অন্য দিকটি হলো অংশগ্রহণকারীদের যেসব সহায়তা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো সব এককালীন, যেখানে অন্য প্রায় সব দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা আজীবন সহায়তা পেতেই থাকেন। সেই হিসাবে এই গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম অন্য কর্মসূচির তুলনায় কম ব্যয়বহুল।

কিছু কিছু পরিবর্তন এনে গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামটি আরও কম খরচে বাস্তবায়নেরও উপায় আছে। যেমন মাঠকর্মীদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার বিষয়টি। পুরো কর্মসূচির সবচেয়ে ব্যয়বহুল অংশ এটি, অংশগ্রহণকারীদের সম্পদ হস্তান্তরে তুলনায় এতে খরচ হয় দ্বিগুণ। উগান্ডায় সম্প্রতি একই ধরনের আরেকটি গবেষণা চালানো হয়েছে। সেখানে মাঠকর্মীরা আরও ঘন ঘন বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবারগুলোর সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু তাতে তেমন কোনো বাড়তি লাভ হয়নি। সুতরাং এখানে কিছু কাটছাঁটের সুযোগ আছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইটা এখন যেন আগের চেয়ে একটু কম অসম বলে মনে হচ্ছে।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও