ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বঙ্গভঙ্গ রদের রাজকীয় ক্ষতিপূরণ

জুলাই ০৩ ২০২০, ১১:০০

Spread the love

 

আগমনী ডেস্কঃঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে বঙ্গভঙ্গ রদের রাজকীয় ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমরা জানি যে, ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের (১৮৫৯-১৯২৫) দায়িত্ব পালনকালে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে দ্বিবিভাজন করা হয়। মুসলিম সংখ্যাগুরু অঞ্চল নিয়ে ঢাকাকে রাজধানী করে “পূর্ববঙ্গ ও আসাম” নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হয়। লর্ড কার্জনের এ পদক্ষেপ “বঙ্গভঙ্গ” নামে পরিচিত। নতুন প্রদেশ গঠনের ফলে পূর্ব বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের শিক্ষাসহ সার্বিক অবস্থার উন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় মুসলিম সমাজ এগে স্বাগত জানায়। অন্যদিকে কলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু ও “ভদ্রলোক” নামে খ্যাত মধ্যবিত্ত পেশাজীবী হিন্দু সমাজ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দ্বিবিভাজনকরণে ব্রিটিশ রাজনৈতিক দূরভিসন্ধী নস্যাৎ- এ আন্দোলনের দৃশ্যমান কারণ বলা হলেও এর পেছনে ধর্মীয় ভাবাবেগ ও পেশাগত স্বার্থই বড় ছিল। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ পূর্ব বাংলার মুসলমানসমাজকে সংগঠিত করে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন মোকাবিলার চেষ্টা করেন। তবে বঙ্গভঙ্গ বিরোধীদের উগ্র সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসী আন্দোলনের কারণে তা ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণা দেয়। ফলে দুই বাংলা আবার একত্রিত হয়। হিন্দুসমাজ ও জাতীয় কংগ্রেস সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। অন্যদিকে মুসলমানসমাজ এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।

বঙ্গভঙ্গ রদের প্রতিক্রিয়ায় পূর্ব বাংলা তথা মুসলিমদের অসন্তোষ নিরসনে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ (১৮৫৮-১৯৪৪) ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা সফরে আসলে নবাব সলিমুল্লাহ নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে একটি মুসলিম প্রতিনিধি দল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে অন্যান্য দাবির সাথে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানান। লর্ড হাডিঞ্জ মুসলিম নেতাদের এ দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করেন এবং পূর্ব বাংলার ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রতিশ্রতি দেন। ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সরকার সিদ্ধান্ত নিলেও এর বাস্তবায়ন সহজ ছিল না। তদানিন্তন বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও সংস্কৃতিজীবীগণ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ শুরু করে। বাবু গিরিশ চন্দ্র ব্যানার্জী, ড. স্যার রাসবিহারী ঘোষ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের নেতৃত্বে হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে ১৮ বার স্মারকলিপি পেশ করেছিলেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারের অনঢ় অবস্থানের কারণে তাঁদের এ প্রয়াস সফল হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ১৯১২ সালের ২৭ মে সরকার ব্যারিস্টার রাবার্ট নাথানকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করে। কমিটি প্রধানের নাম অনুসারে এটি Nathan Commission নামে পরিচিত। এ কমিটি অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে ঢাকায় সরকারি অর্থায়নেপুষ্ট একটি আবাসিক ও শিক্ষাদানকারী রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। সরকার এ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু করার আগেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) শুরু হয়ে যাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত কার্যকরে বিলম্ব ঘটে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ড ১৯১৭ সালের ৬ জানুয়ারি লীডস্ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার মাইকেল ই স্যাডলারকে প্রধান করে “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন” গঠন করেন। মুখ্যত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সুপারিশ প্রদানের দায়িত্বও অর্পিত এ কমিশনের ওপর। ১৯১৯ সালের ১৮ মার্চ স্যাডলার কমিশন ভারত সরকারের কাছে যে রিপোর্ট পেশ করে তাতে ঢাকায় একটি টিচিং-কাম রেসিডেন্সিয়াল স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়। এ প্রস্তাব ভারতীয় আইনসভা হয়ে সিলেক্ট কমিটির মাধ্যমে ১৯২০ সালের ১৮ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিলটি আইনে পরিণত হয়। ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ The Dhaka University Act ( Act no XIII) গভর্নর জেনারেলের অনুমোদন লাভ করে। এ আইন বলে ৩টি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৪৭ জন ছাত্র-ছাত্রী এবং ৩টি আবাসিক হল নিয়ে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকার রমনা এলাকার উন্মুক্ত নৈসর্গিক বিস্তৃত এলাকার ওপর বিলুপ্ত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের পরিত্যাক্ত ভবন ও বাংলোবাড়ি এবং ঢাকা কলেজের জন্য নির্মিত ভবনাদিতে (কার্জন হল ও সন্নিহিত ভবন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।

শতবর্ষে উন্নীত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালে কয়েকটি বিভাগ ও স্বল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভ যাত্রা শুরু হয়েছিল শতাব্দীর পথ পরিক্রমায় এটি আজ বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ১৩টি অনুষদ, ৮৪টি বিভাগ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ১৯টি আবাসিক হল, ৪টি হোস্টেল, ৫৬টির বেশি রিসার্চ সেন্টার, দু’হাজারের বেশি শিক্ষক ও ৪৬ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী, এক হাজারের অধিক কর্মকর্তা ও প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো কর্মচারী নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে। এর বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের উপাদানকল্প ও অধিভুক্ত কলেজ ও ইনস্টিটিউট (Constituent Colleges and Institutes) সংখ্যা ১৩৮টি।

পাঠ্যপুস্তক ভিত্তিক শিক্ষা ও কেবল সনদ প্রদানই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদেশ্য নয়, বরং মেধাবিকাশ, উন্মুক্ত চিন্তা-চেতনার উন্মেষ, বুদ্ধিভিত্তিক চর্চার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, গবেষণা ও সৃজনশীল কর্ম দ্বার উন্মোচন করাই হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। অন্য কথায় বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি জাতির চিন্তা, সৃজনশীলতা চর্চার সবচাইতে উর্বর ক্ষেত্র। স্কুল কলেজে একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে চিন্তার, বোধের বা বিদ্যার যে বীজ রোপিত হয় তাকে কলেবরে, বৈভবে-ঐশ্বর্যে, নান্দনিকতা আর কুশলতায় দিগন্ত বিস্তারী করা দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ মহান দায়িত্বটি ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় গত এক’শ বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে পালন করে যাচ্ছে। বোস-আইনস্টাইন সূত্রের জনক সত্যন্দ্রনাথ বসু, পদ্মভ‚ষণ আচার্য কারিয়ামানিক্যম শ্রীনিবাস কৃষ্ণণ ( কে এস কৃষ্ণণ নামেই বেশি পরিচিত), মহামোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ভাষাবিদ ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্যার এ. এফ. রাহমান, ইতিহাসবিদ ড. আবু মাহমেদ হাবিবুল্লাহ, ড. নলীনীকান্ত ভট্টশালী, জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক, ড. আহমদ শরীফ, ভাষাবিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাই, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, গণিতবিদ ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মোকাররম হোসেন খন্দকার, ড. নাজমুল করিম, কাজী আবদুল ওদুদ ও পটুয়া কামরুল হাসান প্রমুখ বিশ্বখ্যাত শিক্ষকদের স্মৃতিধন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের বাইরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের অগণিত শিক্ষক তাঁদের উদ্ভাবিত বৈজ্ঞানিক আবিস্কার ও জ্ঞানসম্পদ দ্বারা শুধু আমাদের উপমহাদেশকে নয়, বরং পাশ্চাত্য জগতকেও আলোকিত করেছেন। বিশ্বপরিসরে এ বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বলতে দ্বিধা নেই যে, পূর্বসূরীদের এ মহতী অর্জনের ধারা বর্তমান শিক্ষকদের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরেও বর্তমান বাস্তবতা একেবারে হতাশ হওয়ার মতো নয়। সংখ্যায় কম হলেও সদ্য প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, প্রফেসর এমিরেটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো শিক্ষকগণ এখনও শুধু এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, জাতির অহংকার হিসেবেই গণ্য হচ্ছেন। পূর্বসূরীদের ঐতিহ্য রক্ষার্থে বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষকদের অনেকেই পেশাগত কাজে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিষ্ঠার সাথে কাজ করছেন। যুগোপযোগী ও টেকসই জ্ঞানের অবিরত অন্বেষণ, নতুন জ্ঞান সৃজন ও তার প্রকাশ ও প্রসারে নিরবে কাজ করে যাওয়া শিক্ষক এখনও এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক আছেন। যাঁদের অনেকেই বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পাঠ গ্রহণ ও গবেষণা সম্পন্ন করে দেশে এসে তাঁদের অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাও গবেষণার মানোন্নয়নে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরে গৌরব কেবল এর শিক্ষকবৃন্দের মাধ্যমে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটদের মাধ্যমে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধি পায়। এ ভূখন্ডে একটি উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রণী ভূমিকা সুবিদিত। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর শতকরা প্রায় ৭০ ভাগই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। দেশের সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটগণই নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। কেবল দেশে নয়, দেশ অতিক্রম করে বিদেশেও পেশাগত জীবনে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটগণ। শতবর্ষে এ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছে এমন কিছু গ্রাজুয়েট যাদের জন্য শুধু এ বিশ্ববিদ্যালয় নয়, পুরো জাতি অহঙ্কার করে। এসব গ্রাজুয়েটদের মধ্যে কয়েকজনের নামোল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, পিভি নাম্বারের যৌথ আবিষ্কারক বিজয়রাঘবান, পূর্ব বাংলার নারী শিক্ষা ও নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ বিপ্লবী লীলা নাগ, গণিতবিদ ও নিখিল বঙ্গের প্রথম প্রথম মুসলিম মহিলা গ্রাজুয়েট বেগম ফজিলাতুন্নেছা, বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহীম, বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ, কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ইতিহাসবিদ বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী, সাবেক রাষ্ট্রপতি মৃত্তিকা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস, বিখ্যাত মহাকাশ গবেষক ৪০টিরও বেশি সংকর ধাতু উদ্ভাবক আবদুস সাত্তার খান, রেকডি নামক জেনেটিক রিকম্বিনেশনের একটি নতুন জিন ও অযৌন বীজ উৎপাদন (এফআইএস) সংক্রান্ত তিনটি নতুন জিনের আবিষ্কারক জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী, পদার্থবিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রতিষ্ঠাতা এম ইন্নাস আলী, ড. লোং-চ্যাং লিউ’এর সাথে মিলিতভাবে প্রথম Eta-Mesic Nuclei স¤পর্কে ধারণা প্রদানকারী স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. কামরুল হায়দার, ইলেক্টো-অপটিক্সের গবেষণায় অন্যতম পথিকৃৎ পদার্থবিজ্ঞানী মোহাম্মদ আতাউল করিম, ভ‚-গর্ভস্থ আর্সেনিকযুক্ত পানি পরিশোধনের পদ্ধতি আবিষ্কার অধ্যাপক আবুল হুসসাম, পরমানু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, কবি ও কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু, কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ, পদার্থবিজ্ঞানী, বিজ্ঞান লেখক এবং বিজ্ঞান সংগঠক মুহাম্মদ ইব্রাহীম, সঙ্গীতশিল্পী ফেরদৌসী রহমান, ভাষাসৈনিক এম এ মতীন প্রমুখ

পূনশ্চ উল্লেখ্য যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও নতুন জ্ঞানের অনুসন্ধান ও আবিস্কার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কর্তব্য। পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয়ই এ কাজটি করে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অতীতে এ কাজ করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। তবে এর বাইরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অন্যন্য সাধারণ ও ব্যতিক্রমী অর্জন ও ভূমিকা রয়েছে। সেটি হলো বাংলাদেশ নামক একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে নেতৃত্বদান। উল্লেখ্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে পূর্ব বাংলায় একটি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে। আর এই মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজই পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গের সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনে নেতৃত্ব দান করে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামের সূত্রধরে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুচনা হয় তা পরিণতিতে বাঙালি জাতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে মুক্তিসংগ্রাম শুরু করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এর মূল কেন্দ্রভূমি। ১৯৬২ সালের প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে, ৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ নামে খ্যাত ছয় দফাভিত্তিক স্বাধিকার আন্দোলনে, ঊনসত্তুরের গণ অভ্যুত্থানে এবং সর্বোপরি ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের বৌদ্ধিক পাটভুমি বিনির্মাণ, রণাঙ্গণে সশস্ত্র লড়াইসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার পরিচালনায় গৌরবময় অবদান রেখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এমন ভূমিকা পালনের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। শুধু এখানেই শেষ নয়, স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরশাসনসহ সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় রুখে দাঁড়িয়েছে। অগণতান্ত্রিক শক্তির মোকাবিলা করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় এমনকি, প্রাকৃতিক দৈব-দূর্বিপাকেও এ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার সবসময় এগিয়ে এসেছে। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের অতিসংক্রমণের ফলে সৃষ্ট মহাদুর্যোগেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। করোনাকালে এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাস চালু করতে পারেনি। এজন্য বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনার অন্ত নেই। তবে এ দুর্যোগ মুহুর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার এবং দেশের অসহায় সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষায় তার সীমিত শক্তি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ‘জীবনের জন্যই শিক্ষা, শিক্ষার জন্য জীবন নয়’ এ বিবেচনায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ম প্রাধান্য পেয়েছে। এখানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য। এক কথায় বলতে গেলে বাঙালি জাতির যা কিছু মহত্তম ও ইতিবাচক অর্জন সবকিছুর সাথেই জড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। বাংলাদেশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন একে অপরের পরিপূরক।
ঢাকা বিশ্বব্যিালয়ের যে গৌরবগাঁথা শতবর্ষের দ্বারদেশে এসে বর্তমানে তা কতটুকু অক্ষুন্ন আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। অনেকেই মনে করছেন অতীতের গৌরব এখন কিছুটা হলেও হয়ে পড়েছে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অতিমাত্রায় দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা, শিক্ষকদের জ্ঞানচর্চার পরিবর্তে রাজনীতির প্রতি অতিমাত্রায় ঝোঁক ইত্যাদি কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মানের দৃশ্যমান অবনতি ঘটেছে। আন্তর্জাতিক রাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাক্সিক্ষত অবস্থান নিশ্চিত করতে পারছে না। প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধের লালনক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ পরিবেশও ব্যাহত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি স্বাধীনভাবে কথা বলা ও মত প্রকাশের পরিবেশ না থাকে তবে সেখান থেকে সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত মানুষ বের হতে পারে, কিন্তু সৃষ্টিশীল শিক্ষিত মানুষ বের হবে না এমন কথাও এখন উচ্চারিত হচ্ছে। এসব কথা সম্পূর্ণ অমূলক নয়। শিক্ষা, গবেষণা এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ঐতিহ্য যে হয়েছে এটি আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দায় রয়েছে, এটিও সত্য। তবে এখানেই দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকলে চলবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ থেকে বিযুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজকাঠামোতে যে অবক্ষয় দেখা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও এর দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে। যদিও এটি কোনোভাবেই কাম্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো জাতিকে পথ-নির্দেশনা দিয়েছে, পঙ্কিলতার খাদ থেকে টেনে আলোর পথে এনেছে ।

ব্যক্তিগতভাবে আমি সবসময় আশাবাদী মানুষ। শতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি এর চরিত্রগত কিছু পরিবর্তনও ঘটেছে। কিন্তু তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে তাঁর কর্তব্যকর্ম পালন করে যাচ্ছে এবং যাবে। আগামী বছর বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্মশতবর্ষ পালিত হবে। একই বছর পালিত হবে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীও। বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের এ গৌরবময় ক্ষণে দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকে অঙ্গিকার করতে হবে, শুধু অতীত ঐতিহ্য ও গৌরব পুনরুদ্ধার নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আরও অনেক বেশি উচ্চতায়।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও