আজ পহেলা বৈশাখ, স্বাগত ১৪২৫

এপ্রিল ১৪ ২০১৮, ০০:২৩

Spread the love

চৈত্রের রুদ্র দিনের পরিসমাপ্তি শেষে আজ বাংলার ঘরে ঘরে নতুন বছরকে আবাহন জানাবে সব বয়সের মানুষ। বাঙালির জীবনের সবচেয়ে আনন্দের এবং মহিমান্বিত দিন এই পহেলা বৈশাখ। আজ নব আলোর কিরণশিখা শুধু প্রকৃতিকে নয়, রঞ্জিত করে নবরূপে সাজিয়ে যাবে প্রত্যেক বাঙালির হৃদকোণও। নব আলোর শিখায় প্রজ্বলিত হয়ে শুরু হবে আগামী দিনের পথচলা।

হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আজ বাঙালি হারিয়ে যাবে বাঁধভাঙা উল্লাসে। উৎসব, আনন্দ আর উচ্ছ¡াসে ভরে যাবে বাংলার মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। আজকের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো সব জরা গøানিকে মুছে ফেলে সকলে গেয়ে উঠবে নতুন দিনের গান। বৈশাখী উৎসবের মধ্যে দিয়ে যেন বাঙালি তার শিকড় খুঁজে পায়।

১৪২৪-এর আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার হিসাব চুকিয়ে নতুন করে পথচলা শুরু হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সর্বজনীন উৎসবে নববর্ষ উদযাপনে একসঙ্গে গাইবে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’। গ্রাম থেকে শহর, গলি থেকে রাজপথ, আঁকা-বাঁকা মেঠো পথ থেকে অফুরান প্রকৃতি সবখানেই দোল দেবে বৈশাখী উন্মাদনা। মুড়ি মুড়কি, মণ্ডা মিঠাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে নাচে-গানে, ঢাকে-ঢোলে, শোভাযাত্রায় পুরো জাতি বরণ করবে নতুন বছরকে। কেউ কেউ সকালবেলা থেকেই মেতে উঠবে নগর সংস্কৃতির দান পান্তা-ইলিশ খাওয়ার উৎসবে। খোলা হবে বছরের নুতন হিসেব নিয়ে হালখাতা। চলবে মিষ্টিমুখের আসর।

গতকাল শুক্রবার বছরের শেষ দিনে চৈত্র সংক্রান্তির নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে জাতি বিদায় জানিয়েছে ১৪২৫ বঙ্গাব্দকে। আজ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। নববর্ষ উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটির দিন। সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও

চ্যানেলগুলো এ উপলক্ষে প্রচার করছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে ক্রোড়পত্র ও বিশেষ নিবন্ধ।

নির্বিঘ্নে বর্ষবরণ উৎসব পালনে দেশব্যাপী কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। এবারই প্রথম পহেলা বৈশাখ বরণ উপলক্ষে ডিএমপি থেকে ঘোষণা করা হয়েছে পহেলা বৈশাখের দিন বিকেল ৫টার মধ্যে শেষ করতে হবে বৈশাখী সব আয়োজন। সেই সঙ্গে নিষিদ্ধ করা হয়েছে মুখোশও। পাশাপাশি বিকট আওয়াজের ভুভুজেলা বাঁশি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ভুভুজেলার বাঁশি বন্ধের বিষয়টি সর্বমহলে সমাদৃত হলেও বিকেল ৫টার পর উন্মুক্ত স্থানে সাংস্কৃতিক আয়োজন করা যাবে না ঘোষণার কারণে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তবে সন্ধ্যার পর ইনডোরে অনুষ্ঠান করা যাবে।

দিনটিতে দেশবাসীকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ রাজনৈতিক দলের প্রধানরা।

ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এবারো বর্ষবরণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হচ্ছে ছায়ানটের উদ্যোগে রমনা বটমূলে নতুন বছরের আবাহন অনুষ্ঠান। এবার মানবতার বাণী ধ্বনিত হবে ছায়ানটের পুরো আয়োজনে। বরাবরের মতো পহেলা বৈশাখে ভোর সোয়া ৬টায় ভোরের রাগালাপ দিয়ে সূচনা হবে এ আয়োজনের।

রবি ঠাকুরের গানের পংক্তি ‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে’ স্লোগানে পহেলা বৈশাখ ১৪২৩ এর মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হবে সকাল ৯টায় চারুকলা থেকে। শিশু পার্কের প্রবেশদ্বারে নারকেলবীথি চত্বরে গত ৩৩ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী। এবারো তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। আজ সকাল পৌনে ৮টায় শুরু হচ্ছে ঋষিজের বৈশাখী আয়োজন। এবার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করবেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। এতে উপস্থিত থাকবেন গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর। নববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে বিকেল ৫টা থেকে একাডেমির মাঠের নন্দনমঞ্চে থাকছে নববর্ষের অনুষ্ঠান। এতে দেশের খ্যাতনামা সব শিল্পীরা সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি পরিবেশন করবেন। নববর্ষ উপলক্ষে দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি। সকাল ৭টা থেকে একাডেমির নজরুল মঞ্চসহ বিভিন্ন অডিটোরিয়ামে একক বক্তৃতা, কবিতা আবৃত্তি, সঙ্গীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও থাকছে বইয়ের আড়ং। বিকেল ৪টায় বিসিক ও বাংলা একাডেমির যৌথ উদ্যোগে ১০ দিনব্যাপী বৈশাখী মেলার উদ্বোধন করা হবে। এ ছাড়াও রমনার বটমূল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চারুকলা, টিএসসি, ছবির হাট, ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরসহ রাজধানীর সর্বত্রই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত বৈশাখী উন্মাদনায় হারিয়ে যাবে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীসহ সব শ্রেণি-পেশার ও সব ধর্মের মানুষ। এই একটি মাত্র অসা¤প্রদায়িক উৎসব জাতির জীবনে শুধু আনন্দই বয়ে আনে না, বয়ে আনে মানুষে মানুষে স¤প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন তৈরির অনন্য সুযোগ।

‘বাংলা নববর্ষ ১৪২৫’ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্যাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কমসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। বাংলা নববর্ষের তাৎপর্য তুলে ধরে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হচ্ছে। বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে বিভাগীয় শহর, জেলা শহর (বিভাগীয় সদর ব্যতিত) ও সব উপজেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনসহ আলোচনা সভা ও গ্রামীণ মেলার আয়োজন করছে স্থানীয় প্রশাসন। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলা একাডেমি, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটসমূহ, বিসিক নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউণ্ডেশন ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলার আয়োজন করেছে।

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে সব কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিশু পরিবারের শিশুদের নিয়ে ও কারাবন্দিদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে এবং কয়েদিদের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যাদি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউণ্ডেশন এবং প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় জাদুঘর ও প্রতœস্থানসমূহ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হচ্ছে (শিশু-কিশোর, প্রতিবন্ধী ও ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা টিকেটে)। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্ব-স্ব ব্যবস্থাপনায় জাঁকজমকপূর্ণভাবে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করা হচ্ছে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনসমূহ এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। অভিজাত হোটেল ও ক্লাব বিশেষ অনুষ্ঠানমালা ও ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের আয়োজন করেছে।

হোটেল সোনারগাঁও, র‌্যাডিসন, ওয়েস্টিন, ঢাকা রিজেন্সিসহ হোটেল-রেস্টুরেন্টেগুলোর উদ্যোগেও উদযাপিত হবে নতুন বছরের উৎসব। ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, উত্তরা ক্লাবের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে নেয়া হয়েছে নানা আয়োজন। মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোও নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। দিনব্যাপী এমনি নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাঙালি আজ বরণ করে নেবে নতুন বছরকে। বৈশাখের আবহে সবাই মনে মনে ‘রাঙিয়ে দাও রাঙিয়ে দাও আমার সত্তাকে/ আষাঢ় শ্রাবণ কার্তিক পৌষ মাসে/ আমার মনেতে যেন রঙ লেগে থাকে’ এই কামনায় এক সময় বাড়ি ফিরে যাবে সন্ধ্যার আগে।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও