মানিকগঞ্জ লেমুবাড়ির জবেদা বেগম স্বামীসহ থাকেন পলিথিন, বস্তার ঘরে

ফেব্রুয়ারি ২৭ ২০২১, ২০:০২

Spread the love

মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার লেমুবাড়ি গ্রামের জবেদা বেগম (৭৫) ও তার স্বামী আজাহার আলী পলিথিন, বস্তা আর বাঁশ দিয়ে বানানো ঘরে থাকেন বৃদ্ধ দম্পতি। সন্তান থাকলেও বাবা-মায়ের ঠাঁই হয়নি তাদের ঘরে। সন্তানদের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার আর পরনের কাপড় জোগাতেই কেটে গেছে তাদের পুরোটা জীবন। এখন শেষ বয়সে এসে পলিথিনের ঘরে দিন কাটছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তিন ছেলে বিয়ের পর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা থাকেন। ছেলেরা দিনমজুরের কাজ করে তাদের সংসারের খরচই চালাতে পারেন না। যার ফলে বাবা-মাকে দেখতে পারেন না। ভিটেবাড়ি ছাড়া কোনো কৃষি জমি নেই জবেদার স্বামীর। ছেলেদেরকে ওই ভিটে বাড়ি দিয়ে এখন পলিথিনের ঝুঁপড়ি ঘরে কর্মহীন বৃদ্ধ স্বামীকে নিয়ে জীবনযাপন করছেন এই বৃদ্ধা নারী। সাত মাস ধরে তারা সেখানে বসবাস করছেন।

লেমুবাড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে কৃষি জমি। জমিতে ভুট্টা, সরিষা আবাদ করা হয়েছে। পরিত্যাক্ত ৬ শতক জমির এক কোণে মাটি তোলা হয়েছে। সেখানে পলিথিন, সিমেন্টের বস্তা, বাঁশ, ভাঙা টিন, কিছু ইট এবং ৯ থেকে ১০টি বাঁশের খুঁটি দিয়ে বানানো হয়েছে ডেড়ার মতো একটি ঝুঁপড়ি ঘর। ওই ঘরের সামনে ও পূর্বপাশে রান্না করার জন্য দুটি মাটির চুলা। মুরগি পালনের জন্য জমির চারপাশে জাল দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে।

ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, এক পাশে রাখা আছে পানের ডাবর, এক কোণায় একটি পানি রাখার জগ, দুটি বোতল। অন্যদিকে ছিকায় ঝুলানো দুটি গামলা, কিছু ইটের ওপর রাখা হয়েছে মিষ্টি জাতীয় খাবার, দুটি কৌটা, একটি মিষ্টি কুমড়া, সিমেন্টের ব্যাগ আর বদনা। ঘরের চাল হিসেবে দেওয়া হয়েছে ভাঙ্গা টিন আর কয়েকটি বাঁশের খণ্ড। ঘরের ভেতর পানের ডাবর থেকে পান খেতে দেখা যায় জবেদা বেগমকে।

শেষ জীবনে এসে এমন মানবেতর জীবনযাপনের বিষয়ে জানতে চাইলে বৃদ্ধা জবেদা বেগম বলেন, আমার স্বামী কাম করতে পারেন না, আমিও কাম-কাইজ করতে পারি না। এতোদিন ইটের খোলায় কাজ কইরা সংসারে খরচ চালায়ছি। অহন আবার এক চোখে কিচ্চু দেখি না। এইভাবে তো অন্যের বাড়িতে বা ইট খোলায় রান্নার কাজ করা যায় না। আর আমারে কাজেও নেয় না। দুই বছর ধরে এই অবস্থায় আছি।

তিনি আরও বলেন, পোলাপানের কাছে খোরাক চামু কেমনে তাদেরই দিন চলে না। ইটু জুত-জমিও নাই, পোলারা খোলা-টোলা কইরা খায়। এখন চাইবারও পারি না আবার দু-একটা কুরইকা (মুরগি) পালুম তারও পালবার পারি না। তাও মাইনসে বকে, ভাত মিলে না আবার কুইরকা (মুরগি) পালে। জমিও নাই আমাগো। বুইড়া-বুড়ির খাওনের খরচ দিবো কেমনে।

এই ঘরেই থাকেন বৃদ্ধ দম্পতি। জবেদার প্রতিবেশী আব্দুল আজিজ মোল্লা বলেন, প্রতিবেশী হিসেবে আমি ওনাকে বোন বলে ডাকি। তার এমন পরিস্থিতি দেখে আমার খুব কষ্ট লেগেছে। ওনার তিনটা ছেলেই দিনমজুরের কাজ করে। তাদের দিনাতিপাত করতে কষ্ট হয় বিধায় বাপ-মার খোঁজ খবর নেয় না। কুঁড়েঘরের মতো পলিথিন দিয়ে ঘর বানিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন তারা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের জন্য একটি ঘর, কিছু অনুদান বা বয়স্কভাতার ব্যবস্থা করে দেওয়ার দাবি জানাই।

বাবুল শিকদার নামে আরেক প্রতিবেশী বলেন, আমার বাড়ির পাশেই দীর্ঘদিন ধরে ওই ঘরের মধ্যে তারা থাকছে। তাদের কোনো ঘরবাড়ি নাই। আমরা গ্রামবাসীও তাদের সহযোগিতা করেছি। এখন সরকারিভাবে যদি জবেদাকে একটি বয়স্কভাতার কার্ড অথবা বসবাস করার মতো একটি ঘর করে দেওয়া হয় তাহলে আমরা অনেক খুশি হবো।

স্থানীয় বাসিন্দা সোয়েব আহমেদ রাজা বলেন, উনি দিন আনেন দিন খান। খুব কষ্ট করে চলছেন। উনার কিছুই নাই। একটি বয়স্কভাতার কার্ড করে দিলে অন্তত ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন। অসহায় এই জবেদাকে একটি ঘর আর বয়স্কভাতা প্রদানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

জবেদা বেগমের স্বামী আজাহার আলী বলেন, পাঁচ-সাত বছর ধরে নিজে ঠিক মতো কামাই করতে পারি না। কোনো মতে দুজন চলতাছি। দুইদিন কাম করতে পারলে কিছু পয়সা পাই। তাই দিয়াই সদাই আনি আবার দোকান থেকে অনেক সময় বাকি করেও সদাই আইনা খাই। আবার আল্লাহ কাম কারবার দিলে দোকানের বাকি পরিশোধ করি। ছয়-সাত মাস ধরে এই পলিথিনের ঘরে আছি।

তিনি বলেন, আমি মাথায় কিছু নিতে পারি না বলে কেউ আমাকে কাজ দেয় না। আগে কৃষি কাজ, অন্যের বাড়িতে কামলা, ইটের ভাটায় মাটি আনা নেওয়া করা, বিভিন্ন অঞ্চলে ধান কাটার কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতাম। এখন আর ওইসব কাজ করতে পারি না। তাই স্ত্রীকে নিয়ে দুই বছর ধরে মানবেতর জীবন পার করছে।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও