রূপগঞ্জে ঘরে ঘরে কাশি ও জ্বর, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টে হাসপাতালে রোগী ভর্তি বেড়েছে

জানুয়ারি ১৯ ২০২২, ২০:৪৬

Spread the love

নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জঃ করোনার বিভিন্ন ধাপের পরে ওমিক্রনের চিন্তায় দিশেহারা রূপগঞ্জের মানুষ। গত কয়েক দিন ধরে ঘরে ঘরে ঠান্ডা, জ্বর, কাশিতে আক্রান্ত দেখা দেয়ায় ওমিক্রন নিয়ে তোলপাড় চলছে। এনিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। পরিবারের কারো শরীরে জ্বর অনুভব হলেই সবাই আঁতকে উঠছে। আক্রান্ত হওয়ার কোনো খবর না পাওয়া গেলেও উপজেলার একমাত্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি হবার খবর রয়েছে।

রূপগঞ্জ উপজেলা সরকারী হাসপাতালে ঠান্ডাজনিত কারণে শিশু ও বৃদ্ধ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত ৫ দিনে কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও ভাইরাসজনিত কারণে শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে ৫৪ রোগী। এছাড়া বহির্বিভাগে প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছে কয়েকশ শিশু। হাসপাতালে সেবা নিতে আসা এসব শিশুর অধিকাংশই শীতজনিত নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। বিপুলসংখ্যক রোগীর সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসক ও নার্সদের।
শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. ফিরোজ খান জানান, আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শীত যত বাড়ছে, রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব রোগ থেকে রক্ষা পেতে শিশুদের ছয় মাস বয়স পর্যন্ত নিয়মিত বুকের দুধ পান করাতে পরামর্শ দেন তিনি। পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে শিশুর মাদের প্রতি অনুরোধ জানান।

সরেজমিনে ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওমিক্রন চিন্তায় রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার লোকজনের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আবার অনেকে এ নামের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হয়েছেন। যারা ঠান্ডা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে তারা এটাকে টাইফয়েড জ্বর হিসেবে ভেবে নিয়েছে। আর যারা এ রোগের ব্যাপারে অবগত রয়েছেন তারাও খুব চিন্তায় রয়েছেন। পরিবারের কারো শরীরে সামান্যতম জ্বর দেখা দিলেই সবাই আঁতকে উঠছেন।

এদিকে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে জ্বর, সর্দি, কাশি ও নিউমোনিয়াসহ ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। এতে করে উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স হাসপাতালে ঠান্ডাজনিত রোগে প্রতিদিন ১০-১২ জন শিশুসহ নানা বয়সি রোগী ভর্তি হচ্ছে। এর ফলে ঠান্ডাজনিত রোগী অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।

উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, গত ডিসেম্বর মাস থেকে চলতি বছরের মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ডায়রিয়াজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সি ৭৮ জন শিশু এবং নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩ জন। অপরদিকে, ঠান্ডাজনিত রোগে শিশু ছাড়াও নানা বয়সি লোকজন ঠান্ডাজনিত রোগে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের দায়িত্বরত একাধিক নার্স জানান, ঠান্ডাজনিত রোগীদের চাপ অনেক বেশি।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও মেডিকেল ফার্মেসীগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হঠাৎ করেই রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ভাইরাস জ্বরের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে ঠান্ডা জ্বরের রোগীর প্রচন্ড ভীড় বাড়ছে। তবে এখনো পর্যন্ত ওমিক্রন রোগীর সন্ধান মেলেনি বলে হাসপাতালগুলোর সূত্রে জানা গেছে।
হাসপাতালগুলোর তথ্যমতে, গত এক মাসে রূপগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত সর্দি, কাশি, জ্বরের রোগী ভীড় করছে। এদের কেউ এক সপ্তাহ, কেউ ৫ দিন, কেউ ৩ দিন, কেউবা দুইদিন ধরে ভুগছে। হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ৫ জন করে জ্বরের রোগী ভর্তি হচ্ছে।

সে হিসেবে উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ১২ টি বেসরকারী হাসপাতালে প্রায় ২শ’ রোগী ভর্তি হয়। এছাড়া মহল্লায়-মহল্লায় ফার্মেসীগুলোতে জ্বরের রোগীদের প্রতিদিন ভীড় জমে। এদিকে, সরকারি উদ্যোগে নেয়া হয়নি সচেতনতামূলক কোনো কর্মসূচী।
সুর্দি জ্বরে আক্রান্ত ছয় বছর বয়সী স্কুল পড়–য়া সৌরভ মিয়ার মা ভক্তবাড়ি থেকে আসা রাহিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, তার ছেলে গত ১৫ দিন ধরে জ্বরে ভুগতেছে। প্রথমে এলাকার ডাক্তার দেখিয়েছে। কিন্তু কাজ না হওয়ায় ৬ দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। ভয়ে সে তার ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে। তিনি বলেন, টিভির খবরে হুনছি করোনা না কি ওমিক্রন অয় এহন। হের লেইগ্যা ডরে ( ভয়ে ) হাসপাতাল আনছি। আমাগো দিকেতো ঘরে ঘরে ঠান্ডা জ্বর।

খামারপাড়া এলাকার ষাটোর্ধ্ব জায়েদা খাতুন। গত ৫ দিন ধরে সর্দি, কাশি জ্বরে আক্রান্ত। ভয়ে হাসপাতাল এসে ভর্তি হয়েছেন। করোনা হয়েছে কি-না জিজ্ঞেস করতেই বলেন, এতহানি ডাঙ্গর ( বড় ) অইছি এমুন নাম জীবনে হুনি নাই। যহন ঠান্ডা, জ্বও আর খুশখুশি কাশি অইলো বাড়ির লগের মাইনষে কইলো করোনা না ..কি জানি। ধত্তুরি মনে করতে পারতাছি না। হেই ডরে হাসপাতাল ভর্তি অইছি। আর নাইলে কেডায় হাসপাতাল আয়ে। জীবনে কতো এমন ঠান্ডা, জ্বও আর কাশি অইলো। আপনে আপনেই সাইরাগেছে। কোনদিনতো হাসপাতাল আহি নাই। পোড়াবো থেকে এসছেন আট মাসের সাফফান। গত কয়েকদিন ধরে সে ঠান্ডা জ্বরে ভুগছে। সাফফানের মা শরমী সুলতানা বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই ও জ্বরে ভুগছে। প্রথমে টেনশন করিনি। যখন দেখলাম ঠান্ডা, কাশি জ্বর ছাড়ছেনা তখন বাধ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি করাই। কারণ সারাদেশে এখন করোনার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাই মনে ভয় দেখা দিয়েছে। নামটাই বিদঘুটে, তাই ভয়।

ব্রাইট শিশু কানন হাই স্কুলের পরিচালক অ্যাডভোকেট রায়হানা সুলতানা কণা বলেন, হঠাৎ শীতটা একটু বেড়ে যাওয়ায় বাচ্চাদের ঠান্ডা, কাশি, জ্বরের কারণে স্কুলে ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতি কমে গেছে। যদিও আমাদের দিকে করোনার রোগী এখনো পাওয়া যায়নি। তারপরও এ নিয়ে সকল অভিভাবকের মধ্যে একপ্রকার আতঙ্কের ছাঁপ রয়েছে। আমরা আশপাশের বিভিন্ন স্কুলগুলোতে সচেতনতা বাড়াতে ইতিমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি।

আলরাফি হাসপাতালের চেয়ারম্যান, রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি ও কলামিষ্ট মীর আব্দুল আলীম বলেন, কোনো রোগ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। তবে আতঙ্ক আছে। আতঙ্ক মানুষের মন থেকে সচেতনতার মাধ্যমে সরাতে হবে। ইতোমধ্যে রূপগঞ্জ প্রেসক্লাব ও আলরাফী হাসপাতালের উদ্যোগে সচেতনতা কার্যক্রম শুরু করেছে। শীঘ্রই গোটা উপজেলায় ওমিক্রন নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচী পালন করা হবে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ ফয়সাল আহমেদ বলেন, আমরা এখনো পর্যন্ত ওমিক্রনে আক্রান্তের খবর পাইনি। তবে প্রতিদিন অনেক ঠান্ডা,জ্বরে আক্রান্ত রোগী আসে। তবুও সতর্ক থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন সচেতনতা বাড়ানো। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ রওশন আরা খাতুন বলেন, আসলে ওমিক্রন নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। যদিও এ উপজেলায় এখনো এ রোগীর সন্ধান মেলেনি। তবুও সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রওশন আরা খাতুন জানান- ঠান্ডাজনিত কারণে শিশুরহ নানা বয়সি লোকজন ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, শ্বাস কষ্ট, সর্দি ও জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। নিয়মিত চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও