‘গেস্টরুম’ প্রথায় নির্যাতন তিন মাসে নির্যাতনের শিকার ৩০ শিক্ষার্থী * সিট হারানোর ভয়ে নির্যাতন সহ্য করেন শিক্ষার্থীরা

জানুয়ারি ২৯ ২০২২, ১৫:৫৪

Spread the love

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে অতিথিদের জন্য রয়েছে ‘গেস্টরুম’। রাতে এসব গেস্টরুমে হলের শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়-এমন অভিযোগ ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের গুটিকয়েক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। গত তিন মাসে বিভিন্ন হলে কমপক্ষে ত্রিশ জন শিক্ষার্থী গেস্টরুমে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ একরকম নির্বিকার। কারণ আটটি নির্যাতনের ঘটনায় মাত্র একজন ছাত্রলীগ কর্মীকে শাস্তি দিতে পেরেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

ভুক্তভোগী সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে যেতে বাধ্য করা হয় আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের। না গেলে জবাবদিহির জন্য ডাকা হয় গেস্টরুমে। গভীর রাতে হল থেকে বের করে দেওয়াসহ মারধরও করা হয়। এছাড়াও  গেস্টরুমে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সিনিয়রদের সালাম দেওয়া, হ্যান্ডশেক (করমর্দন) করাসহ বিভিন্ন নিয়মকানুনের সবক দেওয়া হয়।

গেস্টরুমে যেতে কেউ অনিচ্ছা প্রকাশ করলে ‘শিবির অপবাদ’ দিয়ে হল ছাড়তেও বাধ্য করা হয়। কোনো শিক্ষার্থীর ফেসবুকে প্রকাশিত মতও যদি বিপক্ষে যায়, তাহলেও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এছাড়া জুনিয়রদের প্রতি বিভিন্ন অসদাচরণ ও অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করে মানসিক নির্যাতন করাও হয় গেস্টরুমে।

করোনা মহামারির অনির্ধারিত ছুটির পর ১০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খুলে দেওয়া হয়। এরপর থেকে কয়েকটি হলে ছাত্রলীগের কোনো কোনো নেতাকর্মী আগের রূপে আবির্ভূত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত তিন মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগের গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রায় ১০ শিক্ষার্থী।

তাদের মধ্যে নভেম্বরে ভারত-পাকিস্তানের খেলা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করা এবং বন্ধুর ফেসবুকে লাইক করায় দুই শিক্ষার্থীকে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠে। এছাড়া বুধবার রাতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আকতারুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থীকে গেস্টরুমে নির্যাতন করার ফলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এর দুই দিন আগে হলের ‘গেস্টরুম’ চালু করা হয়। সেখানে সিনিয়রদের সালাম না দেওয়ায় কয়েকজন নবীন শিক্ষার্থীকে শাসানো হয়। আর এসব ঘটনায় জড়িতদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইনের অনুসারী আবু ইউনুসের কর্মী বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

এবিষয়ে জানতে চাইলে আবু ইউনুস যুগান্তরকে বলেন, অধিকাংশ ঘটনার আমার অনুসারীরা জড়িত এমন অভিযোগ সত্য নয়। তবে বুধববারের ঘটনায় ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তরা আমারই ছোট ভাই। গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করার কোনো সাংগঠনিক নির্দেশনা আমাদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। তাই যারা এ ধরনের কাজ করেছে তাদের দায় সংগঠন নেবে না।

অন্যদিকে আবাসিক হলে কর্তৃপক্ষের চাপাচাপিতে স্যার এএফ রহমান হলে ‘গেস্ট রুমে হাজিরা’ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ছাত্রলীগের একটি অংশ। এ সিদ্ধান্তের খুশিতে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় ৩ ছাত্রকে বেধড়ক পেটানো হয়। ঘটনাটি ১৮ নভেম্বর রাতের। এরপর সর্বশেষ ২৫ জানুয়ারি সিনিয়রদের কথা না মানায় এএফ রহমান হলের দুই শিক্ষার্থীকে গেস্টরুমে ডেকে এনে চড়-থাপ্পড় মারা হয়। এভাবে জিয়া হলে কয়েক শিক্ষার্থীকে মারধর এবং ফজলুল হক মুসলিম (এফএইচ) হলে শিক্ষার্থীদের রুমে রুমে গিয়ে তাদের বের করে দেওয়ার হুমকির অভিযোগ উঠেছে।

এছাড়াও ৭ নভেম্বর রাতে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করার অভিযোগে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের তরিকুল ইসলাম এবং নৃবিজ্ঞান বিভাগের মো. আরিফুল ইসলাম নামের দুই শিক্ষার্থীকে ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে মারধর করেন ছাত্রলীগ কর্মী সিফাত উল্লাহ ও তার এক বন্ধু। সেই ঘটনার পর তার কাছ থেকে মুচলেকা নেয় হল প্রশাসন। কিন্তু এই ঘটনার এক মাসের মাথায় ১৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে না যাওয়ায় ফারসি ভাষা ও সংস্কৃত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী পরশ মিয়াকে হলের ৩৫১ নম্বর কক্ষে মিনি গেস্টরুমের জন্য ডেকে মারধর করেন সিফাত। যদিও পরে তারা বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আবাসিক হল থেকে তাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।

ভয়ে প্রশাসনকে জানানো হয় না : গেস্টরুমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও আবাসিক হলের সিট হারানোর ভয়ে নির্যাতনের বিষয়ে হল প্রশাসনকে না জানাতে বাধ্য হয় শিক্ষার্থীরা। ফলে অধিকাংশ নির্যাতনে ঘটনা গেস্টরুমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ বিষয়ে নির্যাতনের শিকার মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের এক শিক্ষার্থী যুগান্তরকে বলেন, একদিন এক বড় ভাইয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাকে সালাম দিতে ভুলে যাই। পরে কেন সালাম দেইনি, সেই কারণে গেস্টরুমে ডেকে আমাকে গালাগাল করা হয়। একই সঙ্গে আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতনও করা।

হল প্রশসনকে কেন জানানো হয়নি-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গেস্টরুমে নির্যাতন শেষে আমাকে বলা হয়-তোকে ছাত্রলীগ হলে তুলেছে, তাই চাইলে ছাত্রলীগ নামিয়েও দিতে পারে। এরপর প্রশাসন আদৌ আমাকে সাহায্য করবে কিনা সেটা নিয়েও সন্দিহান ছিলাম। তাই সিট হারানোর ভয়ে আমি হল প্রশাসনকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রাব্বানী যুগান্তরকে বলেন, অবশ্যই হলে সবাই নিজ নিজ সম্মান নিয়ে থাকবেন। এটায় কোনো অসুবিধা হলে হল প্রশাসনকে জানাতে হবে। না জানালে তো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। আর হল প্রশাসনে দায়িত্বরতদের অবশ্যই বলব-যে সব শিক্ষার্থী অভিযোগ নিয়ে আসবে, তাদের ব্যাপারে হলের বিধিবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।উৎসঃ দৈনিক যুগান্তর।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও