ঠাকুরগাঁওয়ে ২৪০ বছরেরও অধিক পুরোনো ঐতিহ্যবাহী জামালপুর জমিদার বাড়ি জামে মসজিদ

মে ২০ ২০২২, ১৭:৪৩

Spread the love

আব্দুল্লাহ আল সুমন স্টাফ রিপোর্টার ঠাকুরগাঁওঃ ঠাকুরগাঁও শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী জামালপুর জমিদার বাড়ি জামে মসজিদ।ঠাকুরগাঁও শহর থেকে পীরগঞ্জ যাওয়ার পথে বিমান বন্দর পেরিয়ে শিবগঞ্জহাট। হাটের পশ্চিমে জামালপুর জমিদারবাড়ি জামে মসজিদ।

মসজিদ অঙ্গনে প্রবেশমুখে বেশ বড় সুন্দর একটি তোরণ রয়েছে। মসজিদটির শিল্পকলা দৃষ্টিনন্দিত, মনোমুগ্ধকর ও প্রশংসাযোগ্য। মসজিদে বড় আকৃতির তিনটি গম্বুজ আছে। গম্বুজের শীর্ষদেশ পাথরের কাজ করা। এই মসজিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো মিনারগুলো। মসজিদের ছাদে ২৪টি মিনার আছে। একেকটি মিনার ৩৫ ফুট উঁচু এবং প্রতিটিতে নকশা করা রয়েছে। গম্বুজ ও মিনারের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে অপূর্ব সৌন্দর্য। এত মিনার সচরাচর কোনও মসজিদে দেখা যায় না।

মসজিদটির চারটি অংশ হলো মূল কক্ষ, মূল কক্ষের সঙ্গে ছাদসহ বারান্দা, ছাদবিহীন বারান্দা এবং ছাদবিহীন বারান্দাটি অর্ধ প্রাচীরে বেষ্টিত হয়ে পূর্বাংশে মাঝখানে চার থামের উপর ছাদ বিশিষ্ট মূল দরজা। খোলা বারান্দার প্রাচীরে এবং মূল দরজার ছাদে ছোট ছোট মিনারের অলংকার রয়েছে।

মসজিদটির মূল দৈর্ঘ্য ৪১ ফুট ৬ ইঞ্চি। প্রস্থ ১১ ফুট ৯ ইঞ্চি। মসজিটির বারান্দা দুইটি। প্রথম বারান্দার দৈর্ঘ্য ৪১ ফুট ২ ইঞ্চি ও প্রস্থ ১১ ফুট ৩ ইঞ্চি এবং দ্বিতীয় বারান্দার দৈর্ঘ্য ৪১ ফুট ২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১৯ ফুট ৫ ইঞ্চি। মূল কক্ষের কোণগুলো তিন থাম বিশিষ্ট। এর জানালা দুটি, দরজা তিনটি, কুলুঙ্গি দুটি। মসজিদটির ভিতরে দরজায়, বারান্দায় এবং বাইরের দেয়ালগুলোতে প্রচুর লতাপাতা ও ফুলের সুদৃশ্য নকশা রয়েছে। এক সাথে এই মসজিদে ৩শ’ মানুষ নামাজ আদায় করতে পারে।

ঠাকুরগাঁওয়ের ৫টি উপজেলায় ছড়িয়ে থাকা অনেক পুরাকীর্তির মধ্যে ২৪০ বছরেরও অধিক পুরাতন জামালপুর জমিদার বাড়ির এই মসজিদটি অন্যতম। এর নির্মাণশৈলী ও অপূর্ব কারুকাজ মুগ্ধ করে যেকোনও মানুষকে। ১৭৮০ শতাব্দীতে মসজিদটির ভিত্তি স্থাপন করেন তৎকালীন জমিদার আব্দুল হালিম চৌধুরী।

জামালপুর চৌধুরী পরিবার সূত্রে জানা যায়, পশ্চিম বাংলার তৎকালীন উত্তর দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট মহকুমার রায়গঞ্জ থানার বারোর পরগনা তাজপুর গ্রামে পীর বংশে জন্ম গ্রহণ করেন আব্দুল হালিম। ১৭৬৫ শতাব্দীর দিকে আব্দুল হালিম কাপড়ের ব্যবসার উদ্দেশ্যে তাজপুর থেকে বসন্ত নগরে আসেন। যার বর্তমান নামকরণ করা হয়েছে জামালপুর এবং সেখানে তিনি বসতি স্থাপন করেন।

কাপড়ের ব্যবসা করতে করতে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের জমিদার লালা মুক্তি প্রসাদ নন্দের কাছে লাটের পারপূগী মৌজার প্রায় ১ হাজার বিঘা জমি কেনার মাধ্যমে জমিদারি পান আব্দুল হালিম চৌধুরী। ১৭৭০ দশকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া প্রশাসন তাকে চৌধুরী উপাধিতে ভূষিত করে। জমিদার থাকাকালীন পর্যায়ক্রমে তিনি মোট ২৬ হাজার একর জমি কিনেছিলেন। বর্তমানে সেই জমিগুলো ৩ জেলার ৮ থানায় পড়েছে। থানাগুলো হলো— আটোয়ারি, বালিয়াডাঙ্গী, হরিপুর, রায়গঞ্জ, রাণীশংকৈল, পীরগঞ্জ, বীরগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁও। তখন তিনি ব্রিটিশ চৌধুরী নামে খ্যাত ছিলেন।

জানা যায়, আব্দুল হালিম চৌধুরী ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে তার রাজ প্রাসাদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। রাজ প্রাসাদের দ্বিতীয় তলার নির্মাণ কাজ চলাকালীন ১৭৮০ দশকে ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহবাদ থেকে মিস্ত্রী এনে এই মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন তিনি।
এর কিছুদিন পর আব্দুল হালিম চৌধুরীর মৃত্যু হলে জমিদারত্ব পান তার ছেলে রওশন আলী চৌধুরী। পরে রওশন আলী চৌধুরীর মৃত্যু হলে তার ছেলে জামাল উদ্দীন চৌধুরী জমিদারির দায়িত্বভার বহন করেন এবং মসজিদ নির্মাণ কাজ চলমান রাখেন। জামাল উদ্দীন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার ছেলে নুনু মোহাম্মদ চৌধুরী ১৮০১ দশকে মসজিদটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। মসজিদটি নির্মাণ করতে চার পুরুষের প্রায়

পুরুষের প্রায় ২১ বছর সময় লাগে। মসজিদ নির্মাণের প্রধান দুই মিস্ত্রী হংস রাজ ও রামহিৎ হিন্দু ধর্মের ছিলেন। জমিদারবাড়ির নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার ফলে মসজিদের ব্যয়বহুল নির্মাণ কাজ শেষ হলেও জমিদার বাড়িটির নির্মাণ অসমাপ্ত থেকে যায়।

১৮৮৫ সালের দিকে ইমদাদুর রহমান চৌধুরী সেই স্থানটির নাম বসন্ত নগর পরিবর্তন করে জামাল উদ্দীন চৌধুরীর নামানুসারে জামালপুর নামকরণ করা হয়। বর্তমানে এটি জামালপুর এষ্টেট নামে পরিচিত।

পঞ্চগড়, আটোয়ারী, থেকে মসজিদ দেখতে আসা ডাঃ নুর জামাল বলেন ‘আমি ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্টারনেটসহ, বিভিন্ন গণমাধ্যমে জেনেছি, জামালপুর জমিদারবাড়ি মসজিদ একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। আমি শুনেছি এই মসজিদ প্রায় ২০০ বছরের পুরনো, আজকে নামাজ পড়ে আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো লাগলো।

ঠাকুরগাঁও থেকে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী মোঃ মোরশেদ আলী বলেন, করলাম বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনের মধ্যে, জমিদার বাড়ী জামে মসজিদ অন্যতম ।

উক্ত মসজিদের সেক্রেটারী- মোঃ নুরুল আনোয়ার বলেন, আমাদের মসজিদের অনেক নকশা প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে, এই মসজিদটিকে উজ্জীবিত করার জন্য আমরা সরকারিভাবে কোন সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছি না। এবং আমাদের পক্ষে এটি সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আমি আশা করব আপনারা এ বিষয়ে সরকারকে অবহিত করবেন। এবং সরকারের একান্ত সুদৃষ্টি কামনা করছি।

জামালপুর জমিদারবাড়ি জামে মসজিদের মতোয়াল্লী বলেন, আমাদের বংশধর যেটুকু পারি সেটুকু করে আসছি, আমরা সরকারিভাবে কোনো সাহায্য সহযোগিতা পাইনি। এবং ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসকের কাজ থেকেও কোনো সাহায্য সহযোগিতা পায়নি। আমি আশা করব আমাদের এই মসজিদ সংস্কারের জন্য ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসকের সুদৃষ্টি, ও সরকারের সুদৃষ্টি আশা করছি।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার আবু তাহের মোঃ সামসুজ্জামান বলেন, জামালপুর জমিদারবাড়ি জামে মসজিদটি সংস্করণ করার জন্য ইতমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত। তাই যাতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটি সংস্কারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন তার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও