ঠাকুরগাঁওয়ে স্মৃতি হয়ে থাকলেন শহীদ কমরেড কম্পরাম সিংহ
জেলা প্রতিনিধিঃ কৃষকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমরেড কম্পরাম সিংহের স্মৃতি রক্ষার্থে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার পাড়িয়া ইউনিয়নে নির্মিত শহীদ কমরেড কম্পরাম সিংহ স্মৃতি কমপ্লেক্সের উদ্বোধন করা হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে ঠাকুরগাঁও বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার পাড়িয়া ইউনিয়নের সালডাঙ্গা গ্রামে নির্মিত শহীদ কমরেড কম্পরাম সিংহ স্মৃতি কমপ্লেক্স ফিতা কেটে উদ্বোধন করেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জনাব সাবিরুল ইসলাম।
জানা যায়, ১৯৪০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে কমরেড কম্পরাম সিংহ লাহিড়ী হাটে জমিদারদের স্বেচ্ছাচার মূলক তোলা আদায়ের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত করেন যা রাজনৈতিক ইতিহাসে “তোলাবাটি” আন্দোলন নামে খ্যাত হয়। এই আন্দোলনের নেতৃত্বদানের দায়ে তিনি গ্রেফতার বরণ করেন এবং তিনমাস বন্দী জীবন কাটান। ১৯৪৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পার্টি সম্মেলনে প্রতিনিধিরূপে নির্বাচিত হন।
তোলাবাটি আন্দোলন শেষ না হতেই সমগ্র উত্তরবঙ্গে বর্গা চাষীদের তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত হয় এবং কম্পরাম সিংহ সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বালিয়াডাঙ্গী, রাণীশংকৈল, আটোয়ারী থানায় তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। এই সময় তার উপর সরকারি হুলিয়া থাকায় দুই বছর আত্মগোপন করেন। তিনি জীবনের সমস্ত সঞ্চয় কমিউনিস্ট পার্টিকে দান করে সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে যান।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ শাসনামলে ১৯৪৯-এ পুনরায় গ্রেফতার হন। অন্যান্য কৃষক নেতা কর্মীর সাথে রাজবন্দী হিসেবে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে খাপড়া ওয়ার্ডে অন্তরীণ ছিলেন। এই সময় রাজবন্দিদের উপর মুসলিম লীগ সরকারের অত্যাচার উৎপীড়নের প্রতিবাদে এবং রাজবন্দি ও সাধারণ বন্দিদের মানবেতর পরিবেশ থেকে মানবিক পরিবেশে উন্নীত করার দাবিতে রাজবন্দীরা যে আন্দোলন করেন, রাজশাহী কারাগারে তিনি তার নেতৃত্ব প্রদান করেন।
১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে আটজন রাজবন্দীকে কনডেমড সেল বা ফাঁসির আসামীর নির্জন সেলে আটকে রাখলে তীব্র বিক্ষোভে সামিল হন বাকি বন্দীরা। তাদের কুখ্যাত খাপরা ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। জেলার বিলের নির্দেশে বাইরে থেকে নির্মমভাবে গুলি চালায় কারারক্ষীরা। এর ফলে শহীদ হন সাম্যবাদী কর্মী কম্পরাম সিং। তার সাথে শহীদ হন আরো ছয়জন। শ্রমিক নেতা বিজন সেন, সুধীন ধর, হানিফ সেখ, দিলওয়ার হোসেন, ছাত্র নেতা আনোয়ার হোসেন এবং ছাত্র সংগঠক সুখেন ভট্টাচার্য।
শহীদ কম্পরাম সিংহ স্মৃতি কমপ্লেক্স উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে তেভাগা আন্দোলনের নেতা শহীদ কম্পরাম সিংহকে চির অমর করে রাখলেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহাবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্মকর্তা ফাতেহা তুজ জোহরা এর সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জনাব সাবিরুল ইসলাম, বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা চেয়ারম্যান আলী আসলাম জুয়েল, উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিপুল কুমার,
জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ মাজহারুল ইসলাম সুজন, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী,বালিয়াডাঙ্গী থানার ওসি খায়রুল আনাম প্রমূখ।
এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমাস, উপজেলা কৃষি অফিসার সাজ্জাদ হোসেন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সাইদুর রহমান, উপজেলা তাঁতী লীগের সভাপতি সাদেকুল ইসলাম, উপজেলার সকল দপ্তরের দপ্তর প্রধানগন, ৮ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বৃন্দ, পাড়িয়া ইউনিয়নের সকল মুক্তিযোদ্ধাগন, সকল ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যগণ, শিক্ষক বৃন্দ, কম্পরাম সিংহের পরিবারবর্গের সদস্যবৃন্দ এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র/ছাত্রীবৃন্দ এবং অত্র এলাকার সুধীবৃন্দসহ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক বৃন্দ প্রমূখ।
উদ্বোধন ও আলোচনা সভা শেষে প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার ও শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জনাব সাবিরুল ইসলাম।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিপুল কুমার জানান, বিভাগীয় কমিশনার সাবিরুল ইসলাম মহোদয়ের উদ্যোগে শহীদ কমরেড কম্পরাম সিংহ স্মৃতি কমপ্লেক্সটি নির্মিত হয়েছে। শিক্ষা, গবেষণা ও সামাজিক উন্নয়ন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে এই কমপ্লেক্সটি। এই কমপ্লেক্সটির নির্মিত ব্যয় হয়েছে ১২ লক্ষ টাকা।
আলোচনায় বক্তারা বলেন- কমরেড কম্পরাম সিংহ ভারতবর্ষের তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ১৯৫০ সালে কৃষকদের অধিকার আদায় আন্দোলনে রাজশাহী জেলার খাপড়া ওয়ার্ডে শহীদ হন। তার স্মৃতি রক্ষার্থে এবং অবদানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য স্মৃতি কমপ্লেক্স টি নির্মাণ করা হয়েছে।