সুঁইয়ের ফোড়ে তারা জীবনের গল্প আঁকে নকশী কাঁথায়- ছালেমাদের জীবন বদলের গল্প
নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জঃ রূপগঞ্জের কায়েতপাড়ার ছালেমার অসহায় জীবনের গল্প কেউ শুনেনি। অভাব অনটনের মধ্য দিয়েই তার জীবনের অর্ধেক বয়স অতিবাহিত হয়ে গেছে। অবুঝ তিনটি কণ্যা সন্তান রেখেই স্বামী মারা যান। আবার বিয়ে করেন ছালেমা। ওই সংসারও সুখের মুখ দেখার আগেই স্বামী মারা যান। এরপর আর কেউ তার খবর নিতে আসেনি। তখন থেকেই শুরু ছালেমার সংগ্রামী জীবন। নকশী কাঁথায় জীবনের গল্প আঁকা শুরু করেন। আস্তে আস্তে তার কাঁথার চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আয় রোজগারও বাড়তে থাকে। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দুঃখের দিনে কাউকে পাশে পাননি বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। ছালেমার দেখাদেখি ওই গ্রামের অনেকেই এখন নকশী কাঁথার কারিগর।
আছিয়ার প্রত্যাশার প্রাপ্তিগুলো তাকে করে তুলেছে আরো আশাবাদী। ছেলেমেয়েদের নিয়মিত স্কুলে যাতায়াত, থাকার একটু আশ্রয়, টিউবওয়েল, পাকা পায়খানা, ঘরে রঙিন টেলিভিশন ফ্রিজ সবই আজ ওদের কাছে বাস্তবের সামগ্রী। আছিয়ার মতো বীণা রানী, মোখলেছাদের দিনও পাল্টে গেছে। অভিশপ্ত জীবনের পথ মাড়িয়ে এরা পৌঁছে গেছে এক আলোকিত ভুবনে। অথচ কয়েক বছর আগেও এরা ছিল রূপগঞ্জের পড়শী গ্রামের দরিদ্র বাসিন্দা। কতগুলো ঈদের দিনে নতুন জামা পরেছে হাতে গুনে বলতে পারে ৩৬ বছর বয়সী আছিয়া বেগম। তবে দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হলেও সচ্ছল জীবনের স্বপ¬ দেখত সে।
আত্মপ্রত্যয়ী আছিয়া এবং তার মতো পড়শী গ্রামের ৩৬ জন নারীকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায় রূপগঞ্জ আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সমিতি (রাসাস)। এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ওরা এ সংস্থার দারিদ্র্য বিমোচন আতœকর্মসংস্থান প্রকল্প থেকে হাতে-কলমে নকশিকাঁথা সেলাই ও নার্সারির ওপর প্রশিক্ষণ নেয়। প্রশিক্ষণ থেকে ৩৬ জন নারীর ২০ জন একই সংন্থা থেকে মাত্র দুই হাজার টাকা করে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে শুরু করে নকশিকাঁথা বাণিজ্যিকভাবে সেলাই করার কাজ। কাঁথা সেলাইয়ে ওরা খ্যাতি পেয়েছে। বিভিন্ন বিপণন প্রতিষ্ঠান লুফে নিচ্ছে ওদের পণ্য। বেড়েছে ওদের কর্মপরিধি। ২০ জন নারীর যৌথ উদ্যোগে বর্তমানে কাজ করছে ৫৬ জন দরিদ্র নারী। তারা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে ওদের স্বপ্নের আলোকিত ভুবনের দিকে।
তারা স্বপ্ন দেখেনি আলিশান বাড়িতে বসবাস করার। ছোট্ট ঘরের চালায় টিন উঠুক,স্বামীরা দু’মুঠো ভাতের চিন্তায় প্রতিদিন খাবি খাওয়া থেকে রক্ষা পাক। এই সামান্য স্বপ্ন পূরণের পথও রুদ্ধ ছিল পথপ্রদর্শকের অভাবে। রাসাসের সহযোগিতায় যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে মাত্র কয়েক বছর আগের লালিত স্বপ্ন থেকে বাস্তবের পথে আরো অনেকটা এগিয়ে রয়েছে ওরা। স্ব^ামীরা নিজেদের পেশার পাশাপাশি প্রকল্পের যাবতীয় কেনাকাটায় সাহায্য করছে। প্রকল্পে অন্য মহিলারা কাজ করায় বীণা-আছিয়াদের সামাজিক মর্যাদা বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে আছিয়া বলেন, ‘যেরা আগে দেহা অইলে কতা কইতো না, হেরাই অনে ডাহে আপা পান খাইয়া যান, সবই আল¬াহর ইচ্ছা’। ওদের প্রকল্পে তিন মাসে এখন তৈরি হয় ৫০-৬০টি কাঁথা। একটি কাঁথা তৈরিতে লংক্লথ, সুই-সুতা মিলিয়ে খরচ হয় ৩শ’ থেকে ৪ শ’ টাকা। বিক্রি করা যায় এক হাজার থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। গড়ে ৮ শ’ থেকে ১২ শ’ টাকা মুনাফা হয় কাঁথাপ্রতি। এভাবেই আয়ের হিসাব বোঝায় মোখলেছা বেগম। প্রকল্পের ™ি^তীয় প্রধান তিনি।
মোখলেছা জানান, তার স্বামী আবুল কালাম ঢাকায় রিকশা চালাতেন, একটি দুর্ঘটনায় পায়ে মারাতœক আঘাত পান, সংসার যখন বিষাক্ত অভাব ছোবল মারার জন্য প্রস্তুত তখন এগিয়ে আসে রাসাস এবং আছিয়ারা। সব কিছু মিলিয়ে স্বামী-সংসার নিয়ে সুখেই আছেন মোখলেছা। এ ছাড়া তারা সমিতি থেকে নার্সারির ওপর যে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তাও কাজে লাগিয়েছেন। কাঁথা সেলাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে তারা নিজেদের বাড়ির খালি জায়গায় যে যার মতো গড়ে তুলেছে নার্সারি। নার্সারিতে আলাদা লাভ হচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে ভালো ভাবেই কাটছে ওদের দিন কাল।###