চিরিরবন্দরে এখন সবুজ কচি পাতার ফাঁকে আগুন রূপে কৃষ্ণচূড়ার অপরূপ সৌন্দর্য
এনামুল মবিন(সবুজ),জেলা প্রতিনিধি দিনাজপুরঃ গ্রীষ্মের তাপদাহে চারদিকে কাঠফাটা রোদ্দুর, মাঝে মধ্যে দমকা হাওয়া সহো হঠাৎ বৃষ্টি । প্রকৃতি তার রুক্ষতা ছাপিয়ে নিয়মমতো আপন মহিমায় নিজেকে মেলে ধরেছে। পসরা সাজিয়েছে বিভিন্ন রঙয়ের হাজারও ফুলে ফুলে। সবুজ কচি পাতার ফাঁকে আগুন রূপে কৃষ্ণচূড়ার অপরূপ সৌন্দর্য।
খররোদে তপ্ত দিনে এমনই নয়নাভিরাম কৃষ্ণচূড়া ফুলে দিনাজপুর চিরিরবন্দর উপজেলায় প্রকৃতি যেন, কৃষ্ণচূড়ার ডালি সাজিয়ে রেখেছে। গাছে গাছে ফুটেছে রক্তিম আলো। যার মোহনীয় রূপ সেজেছে উপজেলার পথ-প্রান্তরে। সূর্যের সবটুকু উত্তাপ কেড়ে নিয়েছে টুকটুকে লাল কৃষ্ণচূড়া। প্রখর রোদে পুড়ে জানান দিচ্ছে তার সৌন্দর্যের বার্তা। প্রকৃতিতে নীল আকাশের ক্যানভাসে জ্বলছে গাঢ় রক্তিম রঙ, এ যেন লাল রঙের এক মায়াবী উপজেলার।
উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট বড় কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো আলোক ছটায় তার দ্যূতি বিলিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, সরকারি দপ্তর, বাড়ির উঠান এমনকি বিভিন্ন রাস্তার পাশের গাছগুলো নজর কাড়ছে সে দৃশ্যে। সবুজ সবুজ চিকন পাতা। ফাঁকে ফাঁকে লাল লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল। তার ফাঁকে ডালে ডালে পাখিদের কলকাকলী উড়াউড়ি। হালকা বাতাসে যখন ডালগুলো দোল খায় মনে দোলা দিয়ে যায়। লাল, কমলা, হলুদ ফুল এবং উজ্জ্বল সবুজ পাতা আকর্ষণ করে। কৃষ্ণচূড়ার ঝরে পড়া পাপড়িতে সবুজ ঘাসের উপর সৃষ্টি করেছে যেন রক্তলাল পুষ্পশয্যার। দেখলেই যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। রক্তিম আভা নিয়ে জেগে থাকা কৃষ্ণচূড়া দৃষ্টি কাড়ছে ফুলপ্রেমীদের।
কৃষ্ণচূড়া এক ধরনের বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ, যার ইংরেজি নাম ফ্লেম ট্রি এবং বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া। কৃষ্ণচূড়ার ফুল ফোটার আগে কলি দেখতে মোহরের মতো দেখায়, তাই হিন্দিতে এই ফুলকে বলা হয় গুলমোহর। ফুলের ব্যাস ২-৩ ইঞ্চি। পাপড়ি প্রায় ৮ সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হয়ে থাকে। কৃষ্ণচূড়া জটিল পত্রবিশিষ্ট। প্রতিটি পাতা ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার লম্বা। ২০ থেকে ৪০টি উপপত্র বিশিষ্ট। ফুলের বহিরাবরণ সবুজ। ভেতরের অংশ রক্তিম। কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো বড় চারটি পাপড়িযুক্ত।
কৃষ্ণচূড়ার গাছ উচ্চতায় খুব বেশি হয় না। সর্বোচ্চ ১২ মিটার পর্যন্ত উপরে উঠে। তবে এর শাখা পল্লব অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো থাকে। বহুদূর থেকে দেখলে মনে হয় ওই দূরে আগুন লেগেছে।
প্রথম মুকুল ধরার কিছুদিনের মধ্যেই পুরো গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়। ফুলের প্রধান বৈশিষ্ট হলো উজ্জ্বল রং। তরুরাজ্যে এত উজ্জ্বল রঙ সত্যি দুর্লভ। ফুলের পাপড়ির রঙ গাঢ় লাল, লাল, কমলা, হলুদ, হালকা হলুদ হয়ে থাকে। ফুলের ভেতরের অংশও রক্তিম। বাংলাদেশে এই কৃষ্ণচূড়ার ফুল ফোটে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে, এই ফুল বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ফোটে থাকে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের দুই লাইন মনোমুগ্ধকর গানে উপলব্ধি সৌন্দর্য। ‘কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে, আমি ভুবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে’। ‘রেশমি চুড়ির তালে কৃষ্ণচূড়ার ডালে/পিউ কাঁহা পিউ কাঁহা ডেকে ওঠে পাপিয়া।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানেও কৃষ্ণচূড়ার দর্শন পাওয়া যায়। তিনি লিখেছিলেন, ‘গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো উড়ে তোমার উত্তরী/কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী।’
কবি শামসুর রহমান লিখেছেন, ‘আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে/কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলো কখনো বা/একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়- ফুল নয়, ওরা/শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদবুদ, স্থৃতিগন্ধে ভরপুর।’
স্থানীয়রা বলেন, প্রচন্ড রোদ গরমে বাড়ির বাহিরে যাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বহুদূর থেকে কৃষ্ণচূড়া ফুল দেখা যাচ্ছে। তাই বিকালে বন্ধুবান্ধব মিলে এখানকার সড়কের পাশে থাকা কৃষ্ণচূড়া ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে মানুষ আসছে। এই ফুলের সৌন্দর্য কাছ থেকে না উপভোগ করছেন। অনেকেই মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় সেলফি ও ছবি তুলছেন।
প্রকৃতিপ্রেমী আফিয়া ফারজানা শিউলি বলেন, রাস্তার দু’পাশে কৃষ্ণচূড়া থাকায় একদিকে যেমন মুক্ত বাতাস পাওয়া যায়, অন্যদিকে এর ছায়াতলে বিশ্রামও নেয়া যায়। সৌন্দর্যমণ্ডিত এসব গাছগুলোর আরো পরিচর্যা করা প্রয়োজন।
চিরিরবন্দর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ জোহরা সুলতানা বলেন, কৃষ্ণচূড়া গাছের আরেক নাম গুলমোহর। এর আদি নিবাস-পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কার। এই বৃক্ষ শুষ্ক ও লবণাক্ত অবস্থা সহ্য করতে পারে। এর বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া। এটি ফ্যাবেসি পরিবারের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ। কৃষ্ণচূড়াগাছ উচ্চতা ১২ থেকে ১৫ মিটার হলেও শাখা-পল্লবে এটির ব্যাপ্তি বেশ প্রশস্ত। মুকুল ধরার কিছুদিনের মধ্যে পুরো গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়। কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো বড়, সাত থেকে আটটি পাপড়িযুক্ত, গাঢ় লাল রঙের। পাপড়িগুলো ৮ সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হয়। এ ফুল ফুটতে ৩০ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় বলে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাবদাহে এই ফুল ফোটে।
চিরিরবন্দর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) একে এম শরীফুল হক বলেন, উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় কৃষ্ণচূড়া গাছ রয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও বন বিভাগ সেসব গাছ তদারকি করে। আমরা এবছর বিভিন্ন ধরনের গাছের সাথে আরো কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেব। সৌন্দর্যবর্ধক এই গাছ রক্ষায় আমাদের উপজেলার সকলকে কাজ করতে হবে।