প্রফেসর আনোয়ারের নেতৃত্বে ক্ষুরা রোগের টিকা উদ্ভাবন

অক্টোবর ১৬ ২০১৮, ২১:১২

Spread the love

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বাবিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ক্ষুরা রোগের কার্যকর টিকা উদ্ভাবন হয়েছে। ১৭ সদস্যের গবেষক দল বাংলাদেশে সঞ্চারণশীল ভাইরাস দ্বারা ক্ষুরা রোগপ্রতিরোধের কার্যকর টিকা উদ্ভাবন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগেরMicrobial Genetics & Bioinformatics গবেষণাগারে এ টিকা উদ্ভাবন করা হয়।

যবিপ্রবি জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুর রশিদ প্রেরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।

মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ উদ্ভাবনের ঘোষণা দেন। উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, গত ১ অক্টোবর ২০১৮ সালে এ উদ্ভাবনটি ÔImmunogenic agents, their expression and applications, for effective Prophylaxis of foot and mouth disease’ শিরোনামে বাংলাদেশের পেটেন্টস, ডিজাইনস ও ট্রেডমার্কস অধিদফতরে প্যাটেন্টের জন্য আবেদন করা হয়েছে এবং ভারতে প্যাটেন্ট আবেদন দাখিলের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, গবেষণাকর্ম পরিচালনার জন্য ল্যাব স্থাপনসহ আনুষঙ্গিক ব্যায় মেটানোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন উচ্চশিক্ষা মনোন্নয়ন প্রকল্পের দুটি উপপ্রকল্পের আওতায় ২০১১ ও ২০১৫ সালে মোট ১০ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প কর্তৃক আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল মান্নান, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. মো. ইউসুফ আলী মোল্লা ও অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও লেখক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং টিকা উদ্ভাবন গবেষণা দলের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন, উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. গৌরাঙ্গ চন্দ্র মোহান্ত এনডিসি প্রমুখ।

প্রাণিসম্পদকে বাংলাদেশের কৃষির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপখাত উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলেন, কৃষি অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান ১৩.৬২ শতাংশ ও জাতীয় অর্থনীতিতে ১.৫৪ শতাংশ। দেশের ২০ ভাগ শ্রমশক্তি প্রাণিসম্পদ প্রতিপালনে জড়িত এবং গ্রামীণ জনগণের বড় অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ খাতের সঙ্গে যুক্ত। এ খাত তাদের দৈনন্দিন আয়ের অন্যতম উৎস।

তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হলেও কিছু সংক্রামক রোগ যেমন ক্ষুরা রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে এ খাত তারা কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছাতে পারে না।

শিক্ষামন্ত্রী তার বক্তব্যে আরও বলেন, ক্ষুরা রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে প্রাণিসম্পদকে রক্ষা করতে ড. আনোয়ার হেসেনের নেতৃত্বে গবেষক দলটি ২০১২-২০১৮ সাল পর্যন্ত সারা দেশব্যাপী ক্ষুরা রোগে আক্রান্ত গবাদিপশু থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যমান ক্ষুরা রোগের ভাইরাসের তিনটি সেরোটাইপ [O (80-85%), A (10-15%) এবং Asia l (<5%)] শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।

শনাক্তকৃত ভাইরাসগুলোর সম্পূর্ণ জীবনরহস্য উন্মোচন করে এ রোগকে কার্যকরীভাবে প্রতিহত করার জন্য গবেষক দল প্রতি সেরোটাইপ থেকে একটি করে উপযুক্ত ভাইরাস টিকা তৈরির জন্য নির্বাচন করেন। ক্ষুরা রোগের নতুন ‘ট্রাইভ্যালেন্ট’ টিকা উদ্ভাবন করেন। সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত এ টিকা তৈরির জন্য যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে তা প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অন্তত ৩০ ভাগ কম সময়ে টিকা প্রস্তুত করতে সক্ষম হবে।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, খামারি পর্যায়ে প্রতি মাত্রা টিকা ৬০-৭০ টাকার মধ্যে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। আবিস্কৃত এ টিকা বাংলাদেশে বিদ্যমান ক্ষুরা রোগের তিন ধরনের ভাইরাসের সব প্রকার সংক্রমণ থেকে গবাদিপশুকে অত্যন্ত সফলভাবে সুরক্ষা প্রদানে সক্ষম হবে।

ক্ষুরা রোগকে বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি আশা করি প্রফেসর ড. মো. আনোয়ার হোসেনের এ উদ্ভাবন বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদের টেকসই উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রাখবে।’

গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন তার উপস্থাপনায় ক্ষুরা রোগকে সংক্রামক রোগ উল্লেখ করে বলেন, এ রোগ গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, শূকরসহ অন্যান্য প্রাণীকে আক্রমণ করে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যমতে, এ রোগের কারণে বাংলাদেশে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

তিনি আরও বলেন, টিকা প্রদান এ রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায় এবং বাংলাদেশে প্রধানত আমদানিকৃত টিকার পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত টিকা ও ব্যবহৃত হয়। কিন্তু প্রায়শ টিকাগুলো কাজ করে না। কারণ টিকা উৎপাদনে যে ভাইরাস ব্যবহৃত হয় তা এদেশে বিদ্যমান ভাইরাস থেকে ভিন্ন কিংবা টিকাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ এন্টিজেন থাকে না। তাছাড়া আমদানিকৃত এসব টিকার প্রতিমাত্রার (ডোজ) মূল্য ন্যূনতম ১২০-২০০ টাকা। টিকার এ উচ্চমূল্যের কারণে খামারিরা তাদের গবাদিপশুর জন্য টিকা প্রদানে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এফএও (FAO) এবং বিশ্ব প্রাণিস্বাস্থ্য সংস্থা (OIE) প্রস্তাবিত Progressive Control Pathway for FMD (PCP-FMD) বাস্তবায়ন করছে যেখানে বাংলাদেশের ২০২০ সাল নাগাদ চতুর্থ ধাপে (টিকা প্রদানের মাধ্যমে ক্ষুরা রোগ থেকে মুক্তি) পৌঁছানোর কথা রয়েছে কিন্তু বাংলাদেশ এখনো প্রথম ধাপে অবস্থান করছে। দ্বিতীয় ধাপে উন্নীত হওয়ার জন্য যথাযথ টিকা প্রদান কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ২০১৭ সালের প্রতিবেদন উল্লেখ করে ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের ক্ষুরা রোগের প্রতি সংবেদনশীল গৃহপালিত প্রাণীর (গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া) সংখ্যা প্রায় ৫৫.১৩ মিলিয়ন। কিন্তু স্থানীয়ভাবে তৈরি এবং আমদানিকৃত টিকাসহ দেশে প্রতিবছর ব্যবহৃত টিকার পরিমাণ ২০ লাখ মাত্রার বেশি নয়।

আনোয়ার আরও বলেন, এমতাবস্থায় বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ ক্ষুরা রোগের টিকার চাহিদা থাকা সত্ত্বেও যথাযথ টিকার জোগানে বিশাল ঘাটতি রয়েছে।

ড. আনোয়ার হোসন বলেন, বাংলাদেশে ব্যবহৃত ক্ষুরা রোগের টিকার কারিগরি ত্রুটি ও টিকার যোগানে বিশাল ঘাটতি বিবেচনা করে একটি কার্যকরী টিকা এবং টেকসই ও দ্রুত টিকা উৎপাদন প্রণালী উদ্ভাবন করাই ছিল এ গবেষণা প্রকল্পের মূল লক্ষ্য এক্ষেত্রে দীর্ঘ গবেষণায় আমরা সফলতা পেয়েছি।

অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এ ধরনের গবেষণাকে বাস্তবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য Pilot scale Incubator তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞানমনস্ক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আমি বিনীত আহ্বান জানাই। এটি বাস্তবায়িত হলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা তাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে Innovation–এ রূপান্তর করে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের মতো স্টার্টআপ কোম্পানি তৈরির মাধ্যমে দেশের টেকসই উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন।

অনুষ্ঠানে প্রিন্ট ও ইলেক্টনিক মিডিয়ার প্রতিনিধসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, বাংলাদেশ লাইভস্টক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই), বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পের কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকর্মে নিযুক্ত সিনিয়র শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও