আধিপত্য বিস্তার: পাঁচ বছরে রাজধানীতে যত হত্যাকাণ্ড

নভেম্বর ২৩ ২০১৮, ২০:২৭

Spread the love

চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে রাজধানীতে ১৮৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ঝুট ব্যবসা, ক্যাবল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণসহ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে ১৪টি হত্যাকাণ্ড। বাকিগুলো পারিবারিক কলহ, ছিনতাইসহ অন্যান্য ঘটনা। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত পাঁচ বছরে ৪৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে পুলিশ বলছে, রাজধানীর অপরাধ পরিস্থিত তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।সস্প্রতি রাজধানীর মিরপুরে ঝুট ব্যবসার দ্বন্দ্বের কারণে মিরপুরে খুন হন ঝুট ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন মোহন। গত ৯ নভেম্বর রাতে মিরপুরে সেকশন-১০ এর প্যারিস রোড়ে সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনায় ১২ জনকে আসামি করে পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের স্ত্রী। মামলার এজাহারভুক্ত এক আসামি গ্রেফতার হলেও হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত কাউকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনার তদন্ত চলছে। ঝুট ব্যবসায়ী মোহন হত্যার ঘটনায় এজাহারভুক্ত এক আসামি গ্রেফতার আছে এবং বাকিরা পলাতক রয়েছে, তাদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে। পুলিশ আরও জানায়, মূলত মিরপুর পল্লবী এলাকায় ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের জেরেই মোহন নিহত হন। এর আগেও ঝুট ব্যবসায়ী মোহনের ওপর হামলা হয়েছিল, সেই মামলায় দুই আসামি বর্তমানে কারাগারে আছেন।

মামলা তদন্ত কর্মকর্তা ও পল্লবী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইমরানুল হক  বলেন, ‘ঝুট ব্যবসায়ী মোহন হত্যার মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মিজানুর রহমান ঝিনুককে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’

শুধু মোহনই নয়, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্বে ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাহবুবুর রহমান গামা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা শামসু মোল্লাসহ চারজন খুন হন। একই বছরের ৩ মে বাড্ডা জাগরণী সংসদ ক্লাবে গুলি করে হত্যা করা হয় থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মোফাজ্জল হোসেন রায়হানকে। একই বছরের ১০ আগস্ট কাফরুলের সৈনিক লীগ নেতা রুবেল হোসেনকে হত্যা করা হয়। মিরপুর, কাফরুল, পল্লবী এলাকার গার্মেন্ট ঝুট ব্যবসার দ্বন্দ্বের জেরে এ ঘটনা ঘটে।

পুলিশ সূত্রে ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের (২০১৮ সাল) নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ বছরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে ৪৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এসব ঘটনার মূলে রয়েছে- অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ভাগ-ভাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব, স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ঝুট ব্যবসা, ক্যাবল ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, জমির দখলবাজিসহ স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে ১ হাজার ৬৯টি হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ২৬২টি, ২০১৫ সালে ২৩৯টি, ২০১৬ সালে ১৬৫টি, ২০১৭ সালে ২১৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৮৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২০১৪ সালে রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছরে হত্যাকাণ্ড তুলনামূলকভাবে কমে এসেছে। তবে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চলতি বছরে ১৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের যুগ্ম কমশিনার মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত পাঁচ বছরে ৪৩টি হত্যাকাণ্ড এটি খুব বেশি নয়। কারণ রাজধানীর অপরাধ পরিস্থিত আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। এছাড়াও রাজধানী জুরেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি রয়েছে। শুধু আধিপত্য বিস্তারের জেরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড নয়, দায়ের করা প্রতিটি মামলাই ডিটেকশন করা হয়। এর জন্য বড় ধরণের এসব হত্যাকাণ্ড রাজধানীতে ঘটার সুযোগ বর্তমানে অনেকাংশে কম।’

মিরপুরের ঝুট ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন মোহনের স্ত্রী মোছা. তামান্না বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘ঝুট ব্যবসা করার কারণে প্রায়ই মোহনের পূর্ব পরিচিত ব্যবসায়ীক অংশীদার দীলিপ ও তার সহযোগীরা বিভিন্নভাবে হুমকি দিত। ভয়ভীতি দেখিয়ে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বলতো। এই কারণে আমার স্বামী তিন বছর আগে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছিল। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আজমত গার্মেন্টেসের মালিকের সঙ্গে কথা বলে আবার সে ঝুট ব্যবসা শুরু করে। এর জন্য দীলিপ ও তার সহযোগীরা তাকে হত্যা করতে গুলিও করেছিল। সেই ঘটনায় তিনি পল্লবী থানায় মামলা করেছিলেন। এরপর সেই মামলা তুলে নিতে বারবার হুমকি দিতো তারা। মূলত এই কারণেই পরিকল্পিতভাবে দীলিপ ও তার সহযোগীরা মোহনকে গুলি করে হত্যা করে।’

রাজধানীতে আধিপত্য বিস্তার, স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি, ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ডিশ বা ক্যাবল ব্যবসা ও দখলবাজির কারণেও ঘটেছে হত্যাকাণ্ড। ২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মেরুল বাড্ডার মাছের আড়তে ঢুকে রবিন গ্রুপের নির্দেশনায় আবুল বাশার নামে আরেক সন্ত্রাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই বছরের ২২শে এপ্রিল বাড্ডার বেরাইদ ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের জাহাঙ্গীর আলমের ছোটভাই কামরুজ্জামান দুখু প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হন। এর পরের মাসে (৯ মে) বাড্ডা জাগরণী ক্লাবের ভেতর ঢুকে সস্ত্রাসীরা ডিশ ব্যবসায়ী বাবুকে গুলি করে হত্যা করে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২০১৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আদাবরে খুন হন ওয়ার্ড ছাত্রলীগ নেতা মশিউর রহমান মশু। একই বছনের ৯ আগস্ট মোহাম্মদপুরে খুন হন স্থানীয় যুবলীগ কর্মী তছির উদ্দিন। ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল গেন্ডারিয়া থানা এলাকার স্বামীবাগে কাঁসা-পিতল ব্যবসায়ী জাকির হোসেন খুন হন। একই বছর জানুয়ারিতে গুলশানের কালাচাঁদপুরে হত্যা করা হয় যুবলীগ নেতা মাইনুদ্দীনকে। ২০১৬ সালের জুলাইতে পুরান ঢাকায় খুন হন রাজিবুল হাসান রাজীব। একই বছরের ২২ জানুয়ারি রামপুরায় খুন হন স্যানিটারি ঠিকাদার বাসাই শিকদার (৩০)। ২০১৫ সালের আগস্টে ওয়ারীতে খুন হন আবদুল মান্নান। একই বছরের ৮ এপ্রিল খিলগাঁও জোড়পুকুর এলাকার যুবলীগ নেতা মো. আরিফ হোসেন খুন হন। ২০১৪ সালের ৯ আগস্ট পশ্চিম আগারগাঁওয়ে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগের নেতা জাহাঙ্গীর আলম। একই বছরের ২৩ জানুয়ারি মগবাজারে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাহবুবুর রহমান রানা খুন হন। একই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শ্যামপুরে রিয়াজুল ইসলাম লালুকে হত্যা করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় স্থানীয় আধিপত্য বিস্তার, ক্যাবল ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ওই এলাকা নিজেদের দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে আসছিল সন্ত্রাসী ডালিম-রবিন গ্রুপ। মালয়েশিয়া পলাতক থেকেই ভাড়াটে খুনী দিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য রাজনৈতিক নেতাসহ অনেককেই খুন করেছে এই গ্রুপের সন্ত্রাসীরা। এসব হত্যা মামলার বেশিরভাগ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে কয়েকজন আসামি নিহত হয়েছে। এই কারণে বাড্ডা এলাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কিছুটা কমে এসেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য (উত্তর) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) শাজাহান সাজু  বলেন, ‘রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও ডিশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের কারণে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল সেসব মামলার আসামিদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে। এসব ঘটনায় মামলার চার্জশিট প্রস্তুতের কাজ চলছে। আর এসব হত্যাকণ্ডের নির্দেশদাতারা যারা বিদেশে রয়েছে, তাদের গ্রেফতারের বিষয়ে আমরা কাজ করছি।’

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও