ভয়াবহ অগ্নি ঝুঁকিতে রূপগঞ্জ, চনপাড়া ও গাউছিয়ায় কোন ফায়ার স্টেশন নাই!
নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জঃ ১৯ মার্চ বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে এশিয়ান হাইওয়ে বাইপাস সড়কের গোলাকান্দাইল চৌরাস্তার পাশে ফার্নিচার পট্রিতে এ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এতে প্রায় ৯ টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, বুধবার দুপুরে ফার্নিচার পট্রিতে একটি বৈদ্যুতিক মিটারে বিকট শব্দ হয়। পরে ফার্নিচার পট্রিতে থাকা একটি লেপ তোষকের দোকানে আগুন লেগে যায়। পরে আগুনের লেলিহান শিখা পুরো ফার্নিচার পট্রিতে ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে কাঞ্চন ও আড়াইহাজার ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট টানা এক ঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনেন। ততক্ষনে প্রায় ৯টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
রবিবার (২৪ই-মার্চ) রাত পৌনে তিনটার দিকে ঢাকা সিলেট মহাসড়কের গোলাকান্দাইল এলাকার গাউছিয়া কাঁচাবাজার ও টিনমার্কেটে এ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ৮ টি ইউনিটের ৩ ঘন্টার চেষ্টায় রূপগঞ্জে গাউছিয়া কাঁচাবাজার ও টিনমার্কেটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এতে প্রায় শতাধিক দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, রবিবার রাতে গাউছিয়া কাঁচাবাজারের একটি দোকানে আগুন লেগে যায়। পরে আগুনের লেলিহান শিখা পুরো কাঁচাবাজার ও টিনমার্কেটে ছড়িয়ে পড়ে। দোকানদাররা মার্কেটের সামনের দিকের কয়েকটি দোকানের মালামাল বের করতে পারলেও ভীতরে থাকা সব দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌছে পূর্বাচল, ডেমরা, আদমজী, কাঞ্চন ও আড়াইহাজার ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রনে কাজ করেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন, রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আহসান মাহমুদ রাসেল।
ভাই ভাই মোটরস এর মালিক ক্ষতিগ্রস্ত আব্দুল খালেক বলেন, এ বাজারে আমার মালিকানাধীন ভাই ভাই মোটরস ও টিপু শিকদারের মালিকানাধীন ভূইয়া মোটরস নামের দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ছিল বিভিন্ন গাড়ির পার্টস জাতীয় প্রায় ১২ কোটি টাকার মালামাল। সবগুলো মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মালামাল তোলা হয়েছিল। এখন আমাদের পথে বসা ছাড়া আর উপায় নেই।
হলুদমরিচের দোকানদার জহিরুল হক বলেন, ঈদকে সামনে রেখে ধার দেনা করে বেশি করে মালামাল ক্রয় করেছি বেচার জন্য। আগুনে সব মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ছাই হয়ে গেছে আমাদের স্বপ্ন, আশা আকাঙ্কা, জীবন।
টিন ব্যবসায়ী মোমেন মিয়া বলেন, আগুনে দোকানে থাকা টিনগুলো পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। আমি তো শেষ। এ সর্বনাশা আগুন থেকে কেউ তো আমাদের বাঁচান। গাউছিয়ায় ফায়ার স্টেশন থাকলে হয়তো আমরা নিঃস্ব হতাম না। এখানে দ্রুত ফায়ার স্টেশন চাই।
ব্যবসায়ীরা বলেন, গাউছিয়া একটি শিল্প এলাকা। এখানে ছোট বড় সব মিলিয়ে প্রায় ২শ’ শিল্প প্রতিষ্ঠান ও হাট বাজার রয়েছে। অথচ এই অঞ্চলে ফায়ার স্টেশন নাই। কোন অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটলে বাহিরের এলাকা থেকে ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা এসে আগুন নেভানোর কাজ করেন। দুর থেকে কর্মীর আসতে আসতে আগুনে অর্ধেক পুড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভাতে নেভাতে সব ছাই হয়ে যায়।
আরেক ঘনবসতিপূর্ন, ঝুকিপূর্ন এলাকা হচ্ছে রূপগঞ্জের চনপাড়া। এলাকাজুড়ে রয়েছে বৈদ্যুতিক তারের জঞ্জাল। সরু রাস্তা। ২০ হাজার ঝুপড়ি ঘরে প্রায় দেড় লাখ লোকের বসবাস এখানে। ভয়াবহ অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে এ চনপাড়াও। নেই কোনো অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা। গত ৪৫ বছরে এখানে কমপক্ষে ২০টি স্থানে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটারের মধ্যে রূপগঞ্জে এ চনপাড়া বস্তির অবস্থান। উপজেলার বালু ও শীতলক্ষ্যা নদের তীর ও ডেমরার শেষ মাথায় চনপাড়া। ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি তৎকালীন সরকার নদীভাঙনের শিকার ভূমিহীনদের চনপাড়ায় ওয়াসার ১২৬ একর জমির ওপর পুনর্বাসন করেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, চনপাড়াজুড়ে রয়েছে হাজারও ঝুপড়ি ঘর। ঘরগুলো সাধারণত টিন-কাঠের তৈরি। চনপাড়াজুড়ে রয়েছে বৈদ্যুতিক তারের জঞ্জাল। এসব বৈদ্যুতিক তার থেকে শর্ট সার্কিটের কারণে বড় ধরনের আগুনের ঘটনা ঘটতে পারে। এ ছাড়া চনপাড়ার ঘরে ঘরে, দোকানে দোকানে রয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার। এসব থেকেও বড় ধরনের অগ্নিকা-ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, এখানকার রাস্তাগুলো একেবারেই সরু। এসব রাস্তা দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি তো দূরের কথা কয়েকজন একসঙ্গে হাঁটাও দায়। এলাকার ভেতরে আগুনের ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারবে না। চনপাড়ায় বাড়িঘরের পাশাপাশি রয়েছে প্রশিকা, ব্র্যাক, পিত্র মটিসি, ইউএসটিসিসহ বিভিন্ন এনজিও সংস্থা। রয়েছে সরকারি, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আগুনের ঘটনা ঘটলে বাড়িঘর, বিপণিবিতানের পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানগুলোরও ক্ষতি হবে।
কথা হয় চনপাড়ার শাহাবুদ্দিন মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাজানগো নিজেই তো দেখলেন। এলাকাডায় হাঁটাচলাও কষ্ট। আগুন লাগলে গাড়ি ঢুকবার পারবোনা। আর কারেন্টেরতো কোনো আগামাতা নাই।’
টঙ্গ দোকানি শহিদ মিয়ার সোজা কথা। তার দোকানের ক্ষতি হলে তিনি মরেই যাবেন। তিনি বলেন, ‘যেই ভাবে হারা দেশে আগুন লাগতাছে। হগল সময় ডরে-ডরে থাহি। কহন জানি আমাগো বস্তিত আগুন লাগে।’
চনপাড়া এলাকার ইউপি সদস্য শমশের আলী বলেন, চনপাড়া আগুনের ঝুঁকিতে আছে এটা সত্য। বড় ধরনের আগুনের ঘটনা ঘটলে বড় ধরনের ক্ষতিও হবে। তিনটি রাস্তা ছাড়া বাকি সব রাস্তা চিকন গলির মতো। তিনি বলেন, চনপাড়ায় প্রায় ৬ হাজার ঘর রয়েছে। আগুনের ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকবার।
কাঞ্চন ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার আব্দুল মান্নান বলেন, চনপাড়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এখানে আগুন লাগলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। ঘটতে পারে অনেক হতাহতের ঘটনা। তাদের বেশ কয়েকবার বলা হয়েছে, যেন অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রাখে।
মঙ্গলবার (২৬-শে মার্চ) বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নি দূর্ঘটনায় সম্মিলিত তওবার আহবানে ভূলতা গাউছিয়ায় ও চনপাড়ায় দ্রুত ফায়ার সার্ভিস ষ্টেশনের দাবীতে ইত্তেহাদুল ওলামা রূপগঞ্জ শাখার উদ্যোগে রূপগঞ্জের ঢাকা সিলেট মহাসড়কের গোলাকান্দাইল এলাকায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। ###