স্বাস্থ্যের ড্রাইভার শতকোটি টাকার মালিক,র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার

সেপ্টেম্বর ২১ ২০২০, ১০:১৫

Spread the love
আগমনী ডেস্কঃস্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়ি চালিয়েই শতকোটি টাকার  সম্পদের মালিক বনে গেছেন মো. আবদুল মালেক ওরফে বাদল।হাতিরপুলে নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবন,  প্রথম স্ত্রী নারগিসের নামে তুরাগ থানার দক্ষিণপাড়ায় ছয় কাঠার ওপর সাত তলা ভবন, মেয়ের নামে দক্ষিণ কামারপাড়ায় ১৫ কাঠা জায়গার ওপর ডেইরি ফার্ম। এর বাইরে স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও ভাইয়ের নামে গড়েছেন আরও অঢেল সম্পত্তি। সম্প্রতি মালেকের বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে এমন তথ্যই পেয়েছে গোয়েন্দারা।

দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক দুই দফায় মালেককে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে বিভিন্ন তদবিরে বহাল তবিয়তেই থেকে যাচ্ছিলেন তিনি।

তবে এবার আর শেষ রক্ষা হয়নি। আরও কয়েকটি সংস্থা মালেকের ব্যাপারে অকাট্য প্রমাণ পাওয়ার পর গত শনিবার গভীর রাতে র‌্যাব-১ এর একটি দল টঙ্গীর রমজান মার্কেট এলাকা থেকে মালেককে গ্রেফতার করে। এ সময় তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ বাংলাদেশি জালনোট, একটি ল্যাপটপ ও মোবাইল।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই নিয়োগ-তদবির বাণিজ্য, স্বাস্থ্য অধিদফতরে নামে-বেনামে ঠিকাদারি করে অর্জিত অর্থের বড় একটি অংশ ইতোমধ্যে বিদেশে পাচার করেছেন মালেক। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে। দুর্নীতির দায়ে কারাবন্দী স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবরক্ষক আফজাল সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য মালেক।

মালেকের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ ছিল তাদের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে।র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল বলেন, রাজধানীর তুরাগ এলাকায় মালেকের বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, জাল টাকার ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগ আছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে আমরা এর সত্যতাও পেয়েছি। তিনি তার এলাকায় সাধারণ মানুষকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে শক্তির মহড়া ও দাপট দেখিয়ে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন এবং জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। মালেক ওই এলাকায় রীতিমতো মূর্তিমান আতঙ্ক। তিনি আরও বলেন, অনুসন্ধানে তার আয়-ব্যয়ের সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান ও সম্পদের বিস্তারে অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা যায়। একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়েও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তার একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত আছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। আমাদের বিশ্বাস, রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। জানা গেছে, আর মাত্র এক মাস পর অবসর-পূর্ব ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল গাড়িচালক মালেকের। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস মালেক ১৯৮২ সালে সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পে চালক হিসেবে যোগদান করেন

পরে ১৯৮৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিবহন পুলে চালক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। বর্তমানে তিনি প্রেষণে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদফতরে কর্মরত। তবে মালেকের বিষয়ে তদন্তে নেমে রীতিমতো চোখ কপালে উঠেছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের। তারা বলছেন, নজরদাড়ি এড়াতে দুর্দান্ত কৌশলী ছিলেন মালেক। তার নিজ নামে খুব একটা সম্পদ না থাকলেও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, মেয়ের জামাই ও আত্মীয়স্বজনদের নামে। তৃতীয় শ্রেণির সামান্য গাড়িচালক হলেও তার ক্ষমতার কাছে নতিস্বীকার করতেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পেশাদার সৎ কর্মকর্তারা। মালেকের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ দূরে থাক, তার কথার বাইরে গেলেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নাস্তানুবুদ করে ছাড়তেন তিনি। তথাকথিত বিভিন্ন মিডিয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা খবর প্রকাশ করে ফাঁদে ফেলতেন।সূত্র বলছে, মালেক দুটি বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রী নারগিস আক্তার গৃহিণী। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম রাবেয়া খাতুন। তার আগের স্বামী মৃত ফিরোজ আহমেদ। সাবেক এক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পিএ হিসেবে কাজ করতেন।

 সম্পত্তি : প্রথম স্ত্রী নারগিসের নামে তুরাগ থানায় দক্ষিণপাড়া রমজান মার্কেটের উত্তর পাশে ছয় কাঠার ওপর সাত তলা (হাজী কমপ্লেক্স) আবাসিক ভবনে ২৪টি ফ্ল্যাট। ওই ব্লিডিংয়ের পাশেই রয়েছে ১০ কাঠার একটি প্লট। প্রথম স্ত্রীর মেয়ে বেবির নামে রয়েছে দক্ষিণ কামারপাড়া ৭০ রাজাবাড়ী হোল্ডিংয়ে ১৫ কাঠা জায়গার ওপর ইমন ডেইরি ফার্ম নামে একটি বিশাল গরুর খামার। কলাবাগানের হাতিরপুলে পৈতৃক সাড়ে ৪ কাঠা জমির ওপর ১০ তলা নির্মাণাধীন ভবন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ড্রাইভার্স অ্যাসোসিয়েশনের নামে একটি সংগঠন তৈরি করে সেই সংগঠনের সভাপতি হয়েছেন মালেক। কেবল ড্রাইভারদের নিয়োগ-বদলি ও পদোন্নতির নামে হাতিয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালককে (প্রশাসন) জিম্মি করে ডাক্তারদের বদলি, পদোন্নতি, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেছেন মালেক। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মেয়ে নওরিন সুলতানাকে কম্পিউটার অপারেটর, ভাই আবদুল খালেককে অফিস সহায়ক, ভাতিজা আবদুল হাকিমকে অফিস সহায়ক, বড় মেয়ের স্বামী রতনকে ক্যান্টিন ম্যানেজার, আত্মীয় কামাল পাশাকে অফিস সহায়ক, ভায়রা মাহবুবকে ড্রাইভার এবং ভাগ্নে সোহেল শিকারীকে ড্রাইভার পদে স্বাস্থ্য অধিদফতরে চাকরি দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক হিসেবে তিনি কর্মরত। তবে নিজে গাড়িচালক হয়েও মহাপরিচালকের পাজেরো গাড়িটি হরহামেশাই ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন।

যাদের সঙ্গে যোগাযোগ : স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার অন্যতম আশ্রয়দাতা হিসেবে একাধিক সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গেও তার দহরম মহরম ছিল। বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবির হোসেন চৌধুরী, মো. শাহজাহান ফকির, প্রধান সহকারী সৈয়দ জালাল, অফিস সহকারী জাহাঙ্গীর আলম হচ্ছেন তার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। এ ছাড়া বিএমএ ও স্বাচিপের কয়েকজন নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শাহ মনির হোসেনের আমলে (২০০৯-১০) গাড়িচালক মালেক একাই শতাধিক নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন।

গ্রেফতার মালেকের মেয়ে নাজনিন সুলতানা মিলি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তার বাবার নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে র‌্যাব গ্রেফতার করেছে। করোনা আক্রান্ত হয়ে মাত্র ২০ দিন আগে তিনি আইসিইউ থেকে বাসায় ফিরেছেন।

র‌্যাব-১ অধিনায়ক বলেন, মালেকের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও জাল টাকার ব্যবসায় জড়িত থাকা এবং অস্ত্র ও জাল টাকা উদ্ধারের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট আইনে পৃথক দুটি মামলা হবে। তাকে রাজধানীর তুরাগ থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে র‌্যাবের অনুসন্ধান অব্যাহত।

 

 

 

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও