জামাল খাসোগি ‘হত্যায়’ জড়িত ব্যক্তি সৌদি আরবে গাড়ি চাপায় নিহত!

অক্টোবর ২০ ২০১৮, ১৩:২৩

Spread the love

ইস্তাম্বুলে সৌদি দূতাবাসে সাংবাদিক জামাল খাসোগি নিখোঁজের ঘটনায় জড়িত ১৫ জনের একজন সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তাঁর নাম মেশাল সাদ এম. আল বাস্তানি। ৩১ বছর বয়সী মেশাল বাস্তানি সৌদি বিমান বাহিনীর লেফটেন্যান্ট। রিয়াদে গাড়িচাপায় নিহত না কি তাঁকে হত্যা করা হয়েছে-সে প্রশ্ন তুলেছে তুরস্কের গণমাধ্যম। তুরস্কের সরকার-সমর্থিত দৈনিক ‘ইয়েনি সাফাক’-এর বরাত দিয়ে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

খবরে বলা হয়েছে, মেশাল বাস্তানি সাংবাদিক খাসোগি কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাকে সাজানো সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যা করে খাসোগি হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত কিছু তথ্য-প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ওই ঘাতক দলের অপর ১৪ সদস্যের মুখ চিরতরে বন্ধ রাখতে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে তুরস্কের সরকার-সমর্থিত দৈনিক ‘ইয়েনি সাফাক’।

দৈনিক ইয়ানি সাফাক বলছে, ২ অক্টোবর বিশেষ বিমানে করে যে ১৫ ব্যক্তি সৌদি আরব থেকে ইস্তাম্বুলে উড়ে এসেছিলেন তাদের মধ্যে সাদ আল বাস্তানিও ছিলেন। তবে তিনি কনস্যুলেট ভবনে না গিয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টা ইস্তাম্বুলের উইন্ডহাম গ্র্যান্ড হোটেলে অবস্থান করেন। হোটেল থেকে বের হয়ে তুরস্ক ছাড়েন সৌদির রয়েল বিমান বাহিনীর এই লেফটেন্যান্ট। ১৫ সদস্যের ঘাতক দলে তার দায়িত্ব কী ছিল তা জানা যায়নি। আসলে তার দায়িত্ব স্পষ্ট নয়। তবে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। মেশাল বাস্তানিকে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বিদেশ সফরেও দেখা গেছে।

‘ইয়েনি সাফাক’-এর প্রকাশিত সিসি টিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ১৫ সদস্যে একজন মেহের আবদুল আজিজ ২ অক্টোবর স্থানীয় সময় ৯টা ৫৫ মিনিটে সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করেন। এর কয়েক ঘণ্টা পর সোয়া ১টার দিকে জামাল খাসোগিকে কনস্যুলেটে ঢুকতে দেখা যায়।
মেহের আবদুল আজিজকে যখন তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে দেখা যায় তখন তার পাশেই বড় সুটকেস নিয়ে মেশাল বাস্তানিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

এ বছরের এপ্রিলে ঘূর্ণিঝড় হার্ভের আক্রান্ত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান যুবরাজ সালমান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন মেশাল বাস্তানি। যুবরাজের নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে মেশালকেও দেখা যায়। তিন সপ্তাহের এই সফরে যুবরাজ সালমান অনেকের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সেসময় তার সঙ্গে অন্যদের সঙ্গে মেশাল বাস্তানিও ছিলেন।

এর আগে গতকাল মিডল ইস্ট আইয়ের খবরে বলা হয়েছে, সৌদির সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে টুকরো করে সাত মিনিটেই হত্যা করা হয়েছিল। হত্যার আগে নির্যাতনও করা হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটের ভেতর খাসোগিকে হত্যার পর শরীর টুকরো টুকরো করা হয়। পরে একজন সৌদি ফরেনসিকের নেতৃত্বে খাসোগির মৃতদেহ টুকরো টুকরো করা হয়। এ সময় তিনি তাঁর সহকর্মীদের গান শুনতে বলেন।

তুরস্কের সরকার-সমর্থিত দৈনিক ‘ইয়েনি সাফাক’-এর বরাত দিয়ে বুধবার বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, হত্যার আগে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়েছিল সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁর আঙুল কেটে ফেলা হয়। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর খবরে বলা হয়েছে খাসোগিকে কেটে টুকরো করা হয়।

এর আগে তুরস্ক দাবি করেছিল, খাসোগিকে হত্যার উদ্দেশ্যে সৌদির ১৫ সদস্যের একটি দল ইস্তাম্বুলে উড়ে যায়। তারা জানায়, খাসোগিকে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে হত্যার সপক্ষে তাদের কাছে অডিও এবং ভিডিও প্রমাণ রয়েছে। যদিও ওই সময় এর চেয়ে বিস্তারিত কিছুই জানাননি তুরস্কের কর্মকর্তারা।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে আল-জাজিরা জানিয়েছে, তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা করতে ১৫ সদস্যের স্কোয়াড নিয়োগ দিয়েছিল সৌদি আরব। তুরস্কের সরকার-সমর্থক একটি দৈনিকের এক খবরে ওই ১৫ সদস্যের আততায়ী দলের প্রত্যেক সদস্যের নাম ও ছবি প্রকাশ করা হয়েছে আগে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ‘শীর্ষ কর্মকর্তাদের’ বরাত দিয়ে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ জানিয়েছে, ওই আততায়ী দলে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞও ছিলেন। তিনি হাড় কাটতে করাত সঙ্গে এনেছিলেন। করাত আনার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হত্যার পর খাসোগির দেহ টুকরো টুকরো করা। ওই আততায়ী দলটি হলিউডের সিনেমা স্টাইলে খাসোগিকে হত্যা করে। দুই ঘণ্টার ভেতর মিশন শেষ করে তাঁরা তুরস্ক থেকে বিভিন্ন দেশের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান। খাসোগি হত্যাকাণ্ডকে কোয়েন্টিন তারান্টিনো পরিচালিত হলিউডের সিনেমা ‘পাল্প ফিকশন’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন এক মার্কিন কর্মকর্তা।

তুরস্কের ‘ডেইলি সাবাহ’ খাসোগির ‘হত্যাকাণ্ডে’ জড়িত সন্দেহে আততায়ী দলের ১৫ জনের নাম ও ছবি প্রকাশ করেছে। দৈনিকটি বলছে, ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের কনস্যুলেটে প্রবেশের পর খাসোগিকে হত্যা করে ওই ব্যক্তিরা তুরস্ক ছেড়ে চলে যান। ওই ব্যক্তিরা দুটি ব্যক্তিগত বিমানে করে রিয়াদ থেকে ইস্তাম্বুলে আসেন।

২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলে সৌদির কনস্যুলেটে প্রবেশের পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন খাসোগি। এই দিন ১৫ সৌদি নাগরিকও সেখানে প্রবেশ করেন। তাঁরা কনস্যুলেটে যাওয়ার আগে এর পাশের দুটি আন্তর্জাতিক হোটেলে ওঠেন। কনস্যুলেটের অপারেশন শেষ করে ওই দিনই তাঁরা তুরস্ক ত্যাগ করেন। তাঁদের বহনকারী ব্যক্তিগত বিমান দুটি কায়রো ও দুবাই হয়ে রিয়াদের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।

এদিকে এ ঘটনার তদন্তের সঙ্গে জড়িত একজন কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র এক গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, সন্দেহভাজন তিন ব্যক্তি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত বিশেষ ইউনিটের সদস্য। তাঁদের একজন সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর ফরেনসিক বিভাগের প্রধান বলেও ওই সূত্রটি জানিয়েছে।

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছানির্বাসনে যান খাসোগি। এরপরই ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এ প্রতি মাসে কলাম লিখতেন। কলামে তিনি সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সম্পর্কে নানা সমালোচনামূলক লেখা লিখেছেন। নিজের কলামেই তিনি লেখেন, সালমান বাদশাহ হলে খাসোগি ভিন্নমত পোষণের কারণে গ্রেপ্তার হওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন।

তুরস্কের একটি টেলিভিশনে প্রচারিত সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ওই ১৫ জন আততায়ী তুরস্ক বিমানবন্দরে প্রবেশের পর হোটেলে উঠছেন। খাসোগি কনস্যুলেটে প্রবেশের ঘণ্টাখানেক আগে কিছু গাড়ি দূতাবাসে ঢুকতে দেখা গেছে।

৫৯ বছর বয়সী খাসোগি ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে কাগজপত্র ইস্যু করার জন্য প্রবেশ করেন। কিন্তু তাঁর পরিবার ও বন্ধুবান্ধব এবং তুরস্ক কর্তৃপক্ষের দাবি, তিনি কনস্যুলেট থেকে আর বের হননি। তবে সৌদির কর্মকর্তারা খাসোগির নিখোঁজ ও তাঁর হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁদের দাবি, ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন তিনি। তবে তাঁদের এই দাবির পক্ষে প্রমাণ দিতে রিয়াদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তুরস্কের এই চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার সৌদি আরব জানিয়েছে, ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে তুরস্কের তদন্তকারী দল তল্লাশি করতে পারবে। পরে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, সৌদি কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। কনস্যুলেট ভবনে তল্লাশির অনুমতিও আছে।

তুরস্কের পুলিশ জানিয়েছিল, জামাল খাসোগি যেদিন কনস্যুলেটে যান, সেদিন সৌদি আরব থেকে কর্মকর্তাসহ ১৫ জন ব্যক্তি দুটি ফ্লাইটে তুরস্ক পৌঁছে ইস্তাম্বুলে নিজেদের কনস্যুলেটে যান। ওই দিনই তাঁরা ফিরে যান। তুরস্কের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, ইস্তাম্বুলে পাঠানো সৌদির বিশেষ দলের হাতে জামাল খাসোগি খুন হয়েছেন বলে পুলিশের ধারণা। তথ্যসূত্র: এএফপি, বিবিসি, আল-জাজিরা ও মিডল ইস্ট আই।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও