রূপগঞ্জে ব্যাকিক্রমী জামদানির হাট,গভীর রাতে শুরু সূর্য্য উঠার আগেই শেষ!

নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জে: “আসেন আসেন, হাতে বোনা, টেকসই, মসলিনের বিকল্প বাংলার ঐতিহ্য আসল জামদানি শাড়ি, আমরাই বেচি। নিয়ে নেন, সুলভমুল্যে, অরিজিনাল জামদানি নেন, বিভিন্ন স্থান থেকে নকল শাড়ি কিনে ঠকবেন না। আমাগোডা একেবারেই খাঁটি হাতে বোনা জামদানি, নেন ভাই নেন। শাড়িতেই নারী, না কিনলে ফস্তাবেন। প্রতিটা নারীর বহুল কাঙ্কিত এ জামদানি, নেন ভাই। ভাবীর জন্য, আম্মার জন্য, শ^াশুরীর জন্যও নিতে পারেন এ শাড়ি” এমন হাঁকডাকে মুখর পুরো জামদানির হাট।
শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে রূপগঞ্জের তারাব পৌর এলাকার নয়াপাড়ায় জামদানি হাটের কথা কমবেশি সবারই জানা। এক সময় এখানে বিক্রি হতো মসলিন শাড়ি । এখন বিক্রি হয় জামদানি শাড়ি। এটি এক অন্যরকম হাট। দিনে নয় রাতে বসে এ হাট। তাও আবার মধ্যরাতের পর শুরু হয়ে সূর্যোদয়ের আগেই শেষ। অনেকের কাছেই এটি অবিশ্বাস মনে হবে।
এটি আহামরি কোন হাট নয়। তারপরও প্রতি হাটে কোটি টাকার জামদানি কাপড় লেনদেন হয়। হাটে সেড নেই। ঠায় দাঁড়িয়ে কিংবা মাটিতে চট বিছিয়ে শাড়ি বেচাকেনা চলে। হাটের নিজস্ব কোন জায়গা নেই। নয়াপাড়া জামদানি পল্লীর মাঠেই এ হাট বসে। সরেজমিনে জামদানি হাটে গিয়ে জানা গেছে, বহু আগে রূপগঞ্জের নোয়াপাড়ায় প্রতি মঙ্গলবার জামদানির হাট বসত। নানা প্রতিকুলতার কারনে তা এক সময় চলে আসে ডেমরা বাজারে। বর্তমানে আবার এ হাট নোয়াপাড়ায় বসে প্রতি শুক্রবার। মধ্যরাত থেকে ক্রেতা বিক্রেতা আসতে শুরু করে। বেচাকেনা শুরু হয় ৩ টার পর থেকে। পার্শ্ববর্তী এলাকার জামদানি তাঁতীরা এর বিক্রেতা। নির্জন রাত গাড়ি ঘোড়া কিছুই চলে না। হেঁটে কিংবা নৌকায় চড়ে তাঁতীরা চলে আসেন হাটে। পাইকারদের কেউ কেউ আগে থেকেই হাটে অবস্থান নেয়। সারা দেশ থেকে দল বেধে আসেন অনেক পাইকার।
তাঁতীদের সবার হাতে থাকে ২/১ টি জামদানি শাড়ি। ওরা নিজেরাই এ শাড়ির শিল্পী। পার্শ্ববর্তী নোয়াপাড়া, রূপসী, মৈকুলী, খাদুন,পবনকুল, কাজীপাড়া, মোগরাকুল, সোনারগাও ও সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে আসেন তাঁতীরা। ক্রেতারা আসেন সারা দেশ থেকে । তবে অধিকাংশ ক্রেতাই রাজধানী ঢাকার কাপড় ব্যবসায়ী। স্থানীয় কাপড় ব্যবসায়ীরাও এখানে হাট করতে আসেন। এক একটি শাড়ি দেড় হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিকায় এখানে। জামদানি শাড়ি ছাড়া অন্য কোন কাপড় কিংবা পন্য এ হাটে মিলে না। তবে খুব ভোরে ২/১ জন ঘোল(মাঠা) বিক্রেতা এ হাটে আসেন। এরাই তখন থাকেন এ হাটের প্রধান আকর্ষন। ক্ষুধার্ত-ক্লান্ত হাটুরেরা এক গ্লাস ঘোল (মাঠা) খেয়ে তাদের ক্লান্তি কিছুটা অন্তত দূর করে নেন। এ সময় ঘোল খেতে সবার লাইন পড়ে যায়।
ভোর ৪ টায় পুরো জমজমাট হয়ে ওঠে হাট। তখন ফঁড়িয়া, দালাল, জামদানি তাঁতী, ব্যবসায়ীতে পূর্ণ থাকে। দাড়িয়ে পায়চারি করে তাঁতীদের শাড়ি প্রদর্শন করতে হয়। কেউ কেউ ৩ সপ্তাহ বোনা শাড়ি আবার কেউ ৪ সপ্তাহ বোনা শাড়ি বলে হাকডাক দিয়ে থাকেন। পছন্দ হলেই ক্রেতারা তা দরদাম করে কিনে নেন। প্রতি হাটে এখানে বিক্রি হয় ৫ থেকে ৭ হাজার পিস শাড়ি। লেনদেন হয় প্রায় এক কোটি টাকার ওপরে। শাড়ি পিছু ইজারা দিতে হয় ৫০ থেকে ১ শ’ টাকা। কোন কোন ক্ষেত্রে এর বেশীও আদায় করা হয়।
জামদানির হাট মূলত স্থানীয় মাস্তান ও চাঁদাবাজরা নিয়ন্ত্রন করছে। জামদানি শাড়ি বিক্রেতা শরিফ, গোলাম মাওলা, হাসেম, জহিরুল, আজগর আলী, লোকমান, শাহ আলম, মনির হোসেন জানান, প্রতি মাসে এ হাটে ইজারা বাবদ জামদানি তাঁতীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কয়েক লাখ টাকা। কিন্তু ক্রেতা- বিক্রেতাদের সুযোগ-সুবিধার তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। বেচাকেনার জন্য নিদৃষ্ট স্থান কিংবা শেড নির্মাণ করা হয়নি। ফলে খোলা আকাশের নিচে হাকডাক দিয়ে তাঁতীদের শাড়ি বিক্রি করতে হয়। সামান্য বৃষ্টি হলেই ক্রেতা বিক্রেতারা ভিজে একাকার হন। কখনও দামি সব শাড়ি ভিজে নষ্ট হয়।
এছাড়া হাটে আছে ফঁড়িয়া ও দালালদের দৌড়াত্ব্য। শতাধিক দালালের কাছে তাঁতীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। অবস্থা এমন হয়েছে যে, তাঁতীরা দালাল না ধরলে শাড়ি ঠিক মত বিক্রি করতে পারেন না, পারলেও দাম পায় কম।###