‘রাষ্ট্রীয় অর্থ দলের পেছনে ব্যয় করার নাম লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না’

নভেম্বর ২৯ ২০১৮, ১২:০২

Spread the love
পূর্ব থেকে সূর্যটা পশ্চিমে হেলেছে, বিশ্বায়ণের উতল হাওয়ায় উত্তর-দক্ষিণ মিলেমিশে গেছে। তবুও শ্রেণিহীন সমাজের বীজ বুকে হাতে লালঝাণ্ডা নিয়ে বাম পথে অবিরাম ছুটে চলেছেন কমরেড। স্বাধীন বাংলাদেশে ডাকসুর প্রথম ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজনীতিতে হাতেখড়ি আরও আগে, সেই আইয়ুব বিরোধী লড়াইয়ে। দীর্ঘ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জ্ঞানে ঋদ্ধ তিনি। ঐতিহ্যবাহী ছাত্র ইউনিয়নকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

একাত্তরের রণাঙ্গণে গেরিলা যোদ্ধাদের কমান্ডার ছিলেন। আদর্শ আকড়ে থাকা এই রাজনীতিক এখন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি। সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে ওঠা বাম গণতান্ত্রিক জোটকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বামপন্থি আদর্শের এই নক্ষত্রের নাম মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, জোটভিত্তিক প্রস্তুতি আর সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি কমরেড সেলিমের অভিমত জানতে তার মুখোমামুখি হয় পূর্বপশ্চিম। এই সময়ের রাজনীতিকে নানা যুক্তিতে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। বলেছেন মন খুলে কথা। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আরিফুল ইসলাম সাব্বির।
পূর্বপশ্চিম: দ্বি-দলীয় মেরুকরণের বাইরে পৃথক শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর কথা বলছেন আপনারা বারবার, কিন্তু সেইভাবে জনসম্পৃক্ত হতে পারছেন না। আগামীতে সেটা কতটা সফল হবে বলে মনে করছেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: জনসম্পৃক্ত হতে পারছি না, এ অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ জনসম্পৃক্ততা ছাড়া কোনো আন্দোলন সফল হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে যতগুলো সফল আন্দোলন সব করেছে বামপন্থীরা। ফুলবাড়ি, সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন, যৌন নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, হাওর বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ সব আন্দোলন আমরা করেছি, আমরা ৯৯ ভাগ মানুষের আন্দোলনে এককভাবে ছিলাম। কিন্তু আমরা এই আন্দোলনের শক্তিকে ভোটের শক্তিতে রুপান্তর করতে পারিনি। তবে, সেটাও আমরা করব, পর্যায়ক্রমে। আমরা সেই প্রক্রিয়ায় আছি।
পূর্বপশ্চিম: এগিয়ে আসছে একাদশ জাতীয় নির্বাচন। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দাবি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রস্তুত, সরকার বিরোধী জোটগুলোর বলছে, পক্ষপাত আর জালিয়াতির সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে তারা। এ অবস্থায় আপনার অভিমত?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: গণভবনে দলীয় ডেলিগেটদের সাথে মিটিং করা হচ্ছে, রেডিও টেলিভিশনে ডিজিটাল প্রচার চালানো হচ্ছে ‘থ্যাংক ইউ পিএম’ নামে, এগুলো কার টাকায় হচ্ছে? রাস্তায় উন্নয়নের ফিরিস্তি দেয়া হচ্ছে, এগুলো কার টাকায় হচ্ছে?

তারা বলতে পারে উন্নয়ন প্রচার করার অধিকার আছে, তাহলে আমরা বলতে চাই, এই অধিকার আমারও আছে, আমরাও এই উন্নয়নের ফাঁকিগুলো মিডিয়ায় তুলতে চাই, এই উন্নয়ন খারাপ উন্নয়ন। আমরা বলতে চাই আমরা এই সরকারের মতো উন্নয়ন করব না, আমরা সুষম উন্নয়ন করতে চাই, সেই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। কিন্তু সেটা তো সরকার করতে দেবে না। রাষ্ট্রীয় অর্থ দলের পেছনে ব্যয় করার নাম লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না। এটা ডাহা মিথ্যা কথা।
পূর্বপশ্চিম: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সর্বশেষ সংলাপে আপনাদেরকে কতটা আশ্বস্ত করা হয়েছিল? তার কতটা পূরণ হয়েছে?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সংলাপে শেখ হাসিনা বললেন, শতকরা ৭ ভাগ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ভিক্ষুকরা স্যান্ডেল পরে ভিক্ষা করে, দেশে উন্নয়ন হচ্ছে। জবাবে আমি বলেছিলাম ৭ ভাগ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, ভিক্ষুক স্যান্ডেল পরছে, তো প্রত্যেকটা নাগরিকের মাথাপিছু প্রকৃত আয় ৭ ভাগ বাড়ছে না কেন? যদি তার চেয়ে ১ ভাগও কমে সবার মধ্যে সমান হতো, তাহলে বাকি ৬ ভাগ মুষ্টিমেয়দের কাছে চলে যেত না, এই উন্নয়ন আমরা চাই না।
দ্বিতিয়ত, আপনি ফকিরের কথা বললেন, তাকে আপনি স্যান্ডেল পরাতে পারছেন, কিন্তু তার ফকিরি দূর করতে পারেন নাই। এই হল আপনার উন্নয়নের নমুনা। আইয়ুব খানও উন্নয়ন করে তার ১০ বছর পূর্তি পালন করেছিল। উৎসব করেছিল। মুসলিম লীগ বলেছিলো, সংবিধান বদলে আইয়ুব খানকে আজীবন প্রেসিডেন্ট করতে হবে। উৎসব শেষ হলো, আর তিন মাসের মধ্যেই আইয়ুবের পতন হল। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
পূর্বপশ্চিম: শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে কি?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: ২০১৪’র নির্বাচন ছিলো নো ইলেকশন, আর এবার হচ্ছে ব্যাড ইলেকশন। আমরা নো ইলেকশন বর্জন করেছিলাম, ব্যাড ইলেকশনে অংশ নিচ্ছি। তবে পরিস্থিতি খারাপ হলে এই নির্বাচন আমরা বর্জনও করতে পারি।
পূর্বপশ্চিম: ড. কামাল, ডাঃ জাফরউল্লাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের কথা বলেছিলেন আপনারা, সেই আন্দোলন আলোর মুখ দেখেনি।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আমরা আবেদন জানিয়েছিলাম আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে বিকল্প আরও যারা উদারনৈতিক আছে তারা যদি আসে আমরা একসাথে চলতে রাজি আছি। ড. কামাল হোসেনকেও এটা জানিয়েছিলাম, কিন্তু উনি উনার পথ ধরে অগ্রসর হয়েছেন, এবং এই ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। আমার আমাদের মতো আছি, আমাদের পছন্দের পথে আছি।

পূর্বপশ্চিম: বিএনপি ২০১৪’তে নির্বাচন বয়কট করার ঘোষণা দেবার পর আপনারাও বর্জন করলেন, এবারও ঐক্যফ্রন্টের পরে আপনারাও একই কথা বলে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, সেই সময় আর এখনকার রাজনীতির কি পার্থক্য দেখছেন আপনারা?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: আওয়ামী ও বিএনপি মেরুকরণের এই দুইটাকেই আমরা একই পথের দুইটা শিবির মনে করি। এবং আমাদের রাজনীতি যদি এই দ্বি-দলীয় মেরুকরণে আটকা পড়ে থাকে তাহলে আমাদের দেশ অধঃপতন থেকে রক্ষা পাবে না। নৌকার দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেতে নতুন বিকল্প তৈরি করতে হবে, দুঃশাসনের আরেকটা নব সংস্করণ যেই নামেই হোক, সেটা দিয়ে দেশবাসীর সমস্যা সমাধান করা যাবে না।
মৌলিকভাবে দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক নীতি পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু এখন যারা ধানের শীষে একত্র হয়েছে তারা নৌকার গদির বিরোধিতা করে, কিন্তু তাদের আর্থসামাজিক নীতির বিরোধিতা করে না। তাই এটা দিয়ে ক্ষমতার হাত বদল হবে, কিন্তু দেশের মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না। বামরা সেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তার অংশ হিসেবে আমরা নির্বাচনে এসেছি।
ঐক্যফ্রন্ট দিয়ে ক্ষমতার হাত বদল হয়তো হবে, কিন্তু দেশের মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না। লুটপাট, দুঃশাসনের বাইরে একমাত্র আমাদের জোটই কাজ করছে। দেশ ২ ভাগে বিভক্ত, ৯৯ ভাগ শোষিত আর ১ ভাগ শোষক, তারাই সবাইকে শোষণ করে। আমরা সেই ৯৯ ভাগের পক্ষে। আমাদের উন্নয়ন তাদের জন্যে হবে।
পূর্বপশ্চিম: নতুন ভোটারদের জন্য আপনারা কী বলবেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: নতুন প্রজন্মকে আহ্বান জানাতে চাই, আমদের স্বর্ণযুগকে পিছিয়ে নেওয়াকে উন্নয়ন বলা হচ্ছে, সেটা বড় মিথ্যা কথা। আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। নতুনের ঝাণ্ডা হলো একাত্তর। দেশ পিছিয়ে গেছে, মুক্তিযোদ্ধার মতো সেই নতুনকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এবং সেটা হল মুক্তিযুদ্ধের চার নীতি- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। উৎস-  পূর্বপশ্চিম

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও