সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে

মার্চ ২৪ ২০১৮, ১৫:৩০

Spread the love
বাংলাদেশে চিকিৎসা নিয়ে আহত ১২টি শকুন ফিরে গেল হিমালয় পর্বতমালায়। এমন ঘটনা ১৭ মার্চ সকালের। দিনাজপুরের নর্ত নদীর ধারে দাঁড়িয়ে শতাধিক মানুষ এ দৃশ্য দেখেছেন। শালবনের ওপর দিয়ে পাখা মেলে ‘হিমালয়ী গৃধিনী’ মিলে যাচ্ছে আকাশের নীলে।

আহত শকুনদের সুস্থ করে তোলার কাজ করছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ বন বিভাগ। যে শকুনের প্রতি এত দিন আমাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, আজ তারা মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, এই শকুনই মানুষের বন্ধু। পরিবেশকে মানুষের বাসযোগ্য রাখতে শকুনের ভূমিকা অসামান্য। এই আন্দোলনে তারা কৃষক-শ্রমিক থেকে শুরু করে শিক্ষক, সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করেছে। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বন্য প্রাণীর বিপদ-আপদের খবর পেয়ে  তাঁরা দ্রুত সেখানে যান, উদ্ধার করে আনেন। সুস্থ করে তোলেন। আবার ছেড়ে দেন প্রকৃতিতে।

হিমালয়ের সবচেয়ে বড় পাখিটির ইংরেজি নাম হচ্ছে Himalayan Griffon। বাংলা নাম করা হয়েছে ‘হিমালয়ী গৃধিনী’। আমাদের দেশে পাখিটি শকুন নামে পরিচিত। শীতের শুরুতে হিমালয়ে বরফ জমতে শুরু করলে পাখিগুলো খাবারের সংকটে পড়ে যায়। খাবারের খোঁজে বাংলাদেশে আসে। খাদ্যাভাবে বা উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে কখনো কখনো তারা মাটিতে পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত অনেক শকুনের ভাগ্য নির্ধারিত হয় শিয়াল কুকুরের খাদ্য হিসেবে। এভাবে এই শকুনদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।

অথচ গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত মৃত পশুর মাংস খেয়ে কাক-শিয়াল—কোনো প্রাণীই বাঁচতে পারে না। তারাও আক্রান্ত হয়। এমনকি অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত গরু মাটিতে পুঁতে ফেললেও বহুদিন পর্যন্ত তার জীবাণু সক্রিয় থাক। শুধু শকুনই অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু হজম করে ফেলতে পারে। আক্রান্ত মৃত পশু সরিয়ে ফেলতে শকুনের কোনো বিকল্প নেই। মানুষের মঙ্গলের জন্যই প্রকৃতিতে শকুনের উপস্থিতি অনিবার্য।

এসব কারণে আইইউসিএন ও বাংলাদেশ বন বিভাগ যৌথভাবে আহত শকুন উদ্ধার ও অবমুক্তকরণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে তারা দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার সিংড়া জাতীয় উদ্যানে একটি শকুন উদ্ধার ও অবমুক্তকরণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। চার বছর ধরে এই কর্মসূচি চলছে। এখানে আহত শকুন উদ্ধার করে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। তার পরিচর্যা করা হয়। প্রয়োজনীয় খাবার দেওয়া হয়। একপর্যায়ে যখন তারা উড়ে হিমালয়ে ফিরে যাওয়ার মতো শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করে, তখন তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। গত বছর সাতটি শকুন ছাড়া হয়েছে।

১৭ মার্চ ১২টি শকুন ছাড়া হয়। ১৬ মার্চ সকালে সিংড়া উদ্যানে ‘শকুন উদ্ধার ও অবমুক্তকরণ কেন্দ্রে’ গিয়ে দেখা যায়, কুট কুট করে দুটি শকুন কেন্দ্রের বেড়ার বাঁধন কাটার চেষ্টা করছে। এ দৃশ্য দেখে আইইউসিএনের কর্মকর্তা জেনীন আজমেরী বললেন, এখানকার চিকিৎসা ও সেবায় ওরা সুস্থ হয়ে উঠেছে। এখন যাওয়ার জন্য উচাটন। সেদিন তাদের উড়িয়ে দেওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। পায়ে রিং পরানো হলো, যাতে পরে কোথাও ধরা পড়লে তার খবর পাওয়া যায়।সুস্থ করার পর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে একটি শকুনসুস্থ করার পর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে একটি শকুন

আইউইসিএনের শকুন সংরক্ষণ প্রকল্পের মুখ্য গবেষক সারোয়ার আলম বললেন, ১১ জন সদস্যের একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করা হয়েছে। তারা আহত শকুন উদ্ধারে ভূমিকা রাখে। এই শকুনগুলো মাস তিনেক আগে দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও নীলফামারীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল। একটির গায়ে তির লাগা ছিল। উদ্ধারের পর প্রথমেই তাদের স্থানীয় পশুচিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। কেন্দ্রে চলে পরিচর্যা। স্বভাব অনুযায়ী তাদের খাদ্য সরবরাহ করা হয়। সারোয়ার আলম জানান, তাঁরা এত দিনে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই পাখি সম্বন্ধে মোটামুটি একটা সচেতনতা তৈরি করতে পেরেছেন। এখন যেখানে একটি শকুন আহত হয়ে পড়ুক, সেখান থেকেই তাদের কাছে খবর চলে আসে। তাঁরা সেখান থেকেই উদ্ধার করেন। যাঁরা তাঁদের এই কাজে সহযোগিতা করেন, তাঁরা সবাই স্বেচ্ছাসেবী। তাঁদের মধ্যে বেলাল হোসেন উদ্ধারের পাশাপাশি কেন্দ্রে শকুনদের পরিচর্যা করেন।

 দেখা গেল শকুন ছাড়া উপলক্ষে বেলালের ছোটাছুটির অন্ত নেই। স্থানীয় সাধারণ মানুষও যোগ দিয়েছেন এতে। চিত্রা মুর্মুর বয়স প্রায় ৭৫ বছর। তার ১০০টি মেষ রয়েছে। তিনি উদ্যানে মেষ চরাতে এসেছিলেন। মেষ ছেড়ে দিয়ে তিনিও যোগ দিয়েছেন অনুষ্ঠানে।

সেদিন সিংড়া জাতীয় উদ্যানে এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা থেকে এসেছিলেন বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক জাহিদুল কবির, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার, বাংলাদেশ বার্ডক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক, দিনাজপুর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান, আইইউসিএনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি রাকিবুল আমীন ও শকুন সংরক্ষণ প্রকল্পের মুখ্য গবেষক সারোয়ার আলম।

সব শকুন অবমুক্ত করার পরে রাজশাহীর পথ ধরতেই সন্ধ্যা নামল। তখনো মন থেকে কিছুতেই শকুনের দর্শনীয় উড়াল ভোলা যাচ্ছিল না। কেবলই মনে পড়ছিল জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত কবিতার পঙ্‌ক্তি, ‘হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে’।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও