পৃথিবীর বেশ কিছু জায়গায় এখনও নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ-তসলিমা নাসরিন
পৃথিবীর বেশ কিছু জায়গায় এখনও নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ। এই জায়গাগুলো কোনও না কোনও ধর্মের সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে যুক্ত। গ্রিসের আথস পাহাড়ে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। দু’হাজার গোঁড়া সন্ন্যাসী চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত উপদ্বীপটিতে বাস করেন। সেটিতে তাদের আশ্রম আছে কয়েকটি। ওই পাহাড়ে কোনও মেয়ে-মানুষের প্রবেশাধিকার নেই, কোনও মেয়ে-পশুরও সে অধিকার নেই। শুধু বেড়ালের বেলায় ছাড় আছে, কারণ পাহাড়টিতে বড় ইঁদুরের উৎপাত। এক হাজার বছর ধরে চলছে এই নিয়ম। ইদানীং সন্ন্যাসীদের কেউ কেউ ভয় পাচ্ছেন, কারণ গ্রিসে নতুন জেন্ডার আইন চালু হওয়ার ফলে মেয়েরা পুরুষের আইডি নিয়ে চলে আসতে পারে আথস পাহাড়ে! নতুন জেন্ডার আইনে যে কেউ তার পছন্দমতো লিঙ্গ পরিচয় বেছে নিতে পারে, পরীক্ষা করে দেখা হবে না সে আসলে কোন লিঙ্গের। ফলে সন্ন্যাসীদের আশঙ্কা, মেয়েরা ছেলের আইডি হাতে নিয়ে আথস পাহাড়ে চলে আসবে ঘুরে দেখার জন্য। এলে সব্বনাশ। এক সময় বালক আর খোঁজাদের জন্য এই আথস পাহাড় নিষিদ্ধ ছিল, কারণ ভয় ছিল, বালকের বেশে বা খোঁজার বেশে মেয়েরাও কখনও চলে আসতে পারে। মেয়েদের কী ভীষণ ভয় পেত মানুষ! কেন মেয়ে নিষিদ্ধ? কেউ কেউ বলে ভার্জিন মেরি সাইপ্রাস যাবেন বলে নৌকোয় পাল তুলেছিলেন, কিন্তু হাওয়া তাকে নিয়ে এসেছিল আথস পাহাড়ে। এখানে এসে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি, যে ছেলে যিশুকে বলে দিলেন, এখানেই আমার থাকার ব্যবস্থা কর। যিশু রাজি হলেন। জায়গাটাকে’‘মা মেরির বাগান`ও বলা হয়। মা মেরির বাগানে মেরিই একমাত্র নারী, এই হলো বাগানের বিশেষত্ব। ১৯৫৩ সালে পুরুষের পোশাক পরে একটি মেয়ে ঢুকে পড়েছিল, সেই থেকে সরকারি আইন হয়েছে, কোনও মেয়ে আথস পাহাড়ে গেলে এক বছরের জেল হবে।’‘ জাপানের ওমিনে বা সানজো পাহাড়েও একই নিয়ম। মেয়েরা ঢুকতে পারবে না। গেটেই লেখা আছে, ‘no woman admitted’
‘Regulations of this holly mountain Ominesan prohibits any woman from climbing farther through this gate according to the religeous tradation.’ —Ominesanji temple.
ইউনেস্কো যখন ওমিনে পাহাড়কে ’ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষণা করে, তখনও কিন্তু ওখানে মেয়েদের প্রবেশাধিকার নিয়ে কোনও কথা বলেনি।
ভারতে বেশ কিছু ধর্মীয় স্থানে মেয়েদের ঢোকা বারণ। কেরালার বরিমালা, শ্রী পদ্মানবস্বামী মন্দির, ছত্তিশগড়ের মাওয়ালি মাতা মন্দির, হরিয়ানা-পাঞ্জাবের সীমান্তে কার্তিকে মন্দির, আসামের পতবৌসি সাত্রা, ঝাড়খণ্ডের মংগলচণ্ডী মন্দির, আসামের কামাখ্যা মন্দির, রাজস্থানের জৈন মন্দির, কেরালার শ্রীকৃষ্ণ মন্দির। ব্রহ্মচর্য পালন হচ্ছে, সুতরাং মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। মহারাষ্ট্রের শনি শিংনাপুর মন্দিরের গর্ভগৃহে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। মুম্বাইয়ের হাজি আলি দরগার আশপাশে মেয়েদের যেতে দেওয়া হতো না। হাজি আলি নামে কোনও এক দরবেশের কবর এটি। এতে ঢোকার জন্য ভারতীয় মুসলিম মহিলারা জনস্বার্থের মামলা করার পর এখন ঢোকার অনুমতি পেয়েছেন বটে, কিন্তু গর্ভগৃহে এখনও প্রবেশাধিকার নেই। গর্ভগৃহকে পবিত্র ভাবা হয়, সে কারণেই নারীকে সেখানে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় না। কারণ নারী, লোকে বিশ্বাস করে, আপাদমস্তক অপবিত্র। একসময় গৃহকাজ করা, স্বামীসেবা করা, স্বামীর পরিবারের সকলের যতœআত্তি করা, সন্তান জš§ দেওয়া, সন্তান লালন-পালন করা ছাড়া আর কোনও কিছু, বিশেষ করে নিজের জন্য কিছু করার অধিকার ছিল না নারীদের। যুগ পাল্টেছে, নারীরা ঘরের বাইরে বেরোচ্ছেন, বিদ্যালয়ে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, পড়াচ্ছেন, স্বাবলম্বী হচ্ছেন, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার জজ ব্যারিস্টার বিজ্ঞানী বৈমানিক সবই হচ্ছেন, এমনকি মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীও হচ্ছেন, কিন্তু তারপরও গা থেকে পুরুষতন্ত্রের সেঁটে দেওয়া ‘অপবিত্র’ ট্যাগ সরাতে পারছেন না। নারী অপবিত্র, যেহেতু নারী ঋতুমতী, রজস্বলা। বিজ্ঞান বিষয়ে যাদের সামান্যতম জ্ঞান নেই, তারাই জীবনভর এমন কুসংস্কারের নষ্ট জলে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। ‘অপবিত্র’
ভারতে শবরীমালা নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। সুপ্রিম কোর্ট শবরীমালায় মেয়েদের প্রবেশাধিকারের পক্ষে রায় দিয়েছে। কিন্তু প্রভু আয়াপ্পার ভক্তরা সেই রায় কার্যকর হতে দেবেন না। ভক্তদের মধ্যে পুরুষ নারী দুজনই আছে। নারী-ভক্তরা রীতিমতো মারধর করে নারী-দর্শনার্থী বিদেয় করেছে। শেষ পর্যন্ত পুরোহিতও মেয়েদের ঢুকতে দিতে বাধা দিয়েছেন। প্রভু আয়াপ্পার ভক্তদের কাছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের এক ফোঁটা মূল্য নেই। মূল্য শত শত বছর ধরে চলে আসা ট্রাডিশনের। মন্ত্রীরাও যাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে। হিন্দু ভোট আবার ফসকে না যায়, সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোও নারীর প্রবেশ নিষেধের পক্ষেই বলছে অথবা মুখে কুলুপ এঁটে আছে।
ধর্ম মানেই পুরুষতন্ত্র আর নারীবিদ্বেষ। কোনও ধর্ম নারীর সমানাধিকার মানেনি। ভারতের শবরীমালা মন্দির যে কারণে মেয়েদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে, একই কারণে হাজি আলী দরগা করে, গ্রিসের আথস পাহাড় করে। ইহুদিদের সিনেগগে পুরুষদের থেকে মেয়েদের দূরে, আলাদা জায়গায়, চোখের আড়ালে বসানো হয়। বেশির ভাগ মসজিদে মেয়েদের ঢোকা বারণ, যদি কোথাও মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ না হয়, সম্পূর্ণ দৃষ্টির বাইরে রাখা হয় তাদের। থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে যেখানে বুদ্ধের শরীরের অংশবিশেষ রক্ষিত আছে, সেসব পবিত্র জায়গায় মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ।
ছোটবেলায় দেখতাম মসজিদ আর কবরখানার গেটে লেখা, মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ,। প্রবেশ নিষেধ লেখা না থাকলেও মহিলাদের প্রবেশ অনেক জায়গায় অনাকাক্সিক্ষত, সে মহিলারাও জানেন। পুরুষেরা যেসব জায়গার সর্বময় কর্তা হয়ে আছেন, সেসব জায়গায় একটা অলিখিত নিষেধাজ্ঞা মেয়েদের জন্য আছেই। সাহিত্যের জগতে, শিল্পের জগতে, বাণিজ্যের জগতে, বিজ্ঞানের জগতে। কোথাও কোথাও তো মানুষ ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে মেয়ে দেখলে। ভারতের মাটিতে ব্রিটিশদের তৈরি ক্লাবগুলোতে কয়েক বছর আগ পর্যন্তও মেয়েদের সদস্য হওয়ার অধিকার ছিল না। স্কটল্যান্ডের এক গলফ ক্লাবে মেয়েদের সদস্য হওয়ার অধিকার নেই, জাপানের সুমো রিং-এ নেই। সৌদি আরবের মেয়েদের পুরুষ-অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া দেশের বাইরে বেরোবার অধিকার নেই। মেয়েদের বিরুদ্ধে গোটা পৃথিবী এক জোট। যারা শবরীমালায় এখন জোর জবরদস্তি মেয়েদের প্রবেশ করাতে চান, তারা কি মনে করেন, প্রবেশ করলেই মেয়েরা সমানাধিকার পেয়ে যাবে? সমাজে মহাসমারোহে নারীবিরোধী অনুষ্ঠান পালন করা হচ্ছে, বিয়ে, সিঁদুরখেলা, করভা চৌথ! বিয়েতে পুরুষের হাতে নারীকে সমর্পণের মন্ত্র উচ্চারিত হয়। সেই মন্ত্র কি সামান্যও মানে নারীর সমানাধিকার? তিন তালাক নিষিদ্ধ হয়ে গেলে প্রচুর লোক ভেবেছে মুসলিম মেয়েরা তাদের সমানাধিকার পেয়ে গেছে। এসব খুব ভুল ধারণা। সমাজে মেয়েরা মেয়ে হয়ে জšে§ছে বলে এখনও নির্যাতিত, এখনও মানুষ বলে গণ্য হয় না, মেয়ে শিশুদেরও যৌন নির্যাতন থেকে রেহাই দেওয়া হয় না, এখনও মেয়েরা ঘরে বাইরে ধর্ষণের শিকার, গণধর্ষণ আর হত্যাকাণ্ডের শিকার। এখনও মেয়েদের ভুগতে হয় দারিদ্র্য, পণ, গৃহহিংসা, পরনির্ভরতা ইত্যাদি নানা কারণে। মেয়েদের শরীর এবং মন নিয়ন্ত্রণ করে প্রভু পুরুষ। বন জঙ্গলের কোনও মেয়ে-জন্তুকে এতটা অত্যাচারিত হতে হয় না, যতটা হতে হয় সভ্য জগতের মেয়ে-মানুষদের। সমানাধিকার ওদের আছে, আমাদের নেই। আমরা নানা রকম উপাসনালয় গড়ে তুলেছি আমাদের কল্পনার ঈশ্বরের স্তুতি গাওয়ার জন্য, যে ঈশ্বর প্রবল নারীবিদ্বেষী। কী দরকার নারীদের মন্দিরে আর উপাসনালয়ে দৌড়োনোর? কী দরকার সেইসব প্রভুর সামনে মাথা নোয়ানোর, যারা নারীকে অপবিত্র, নোংরা, নিকৃষ্ট, দুর্বল, কুটিল, জটিল, অচ্ছুৎ, অসতী, বিশ্বাসযোগ্য নয়Ñ এমন বিশেষণে ভূষিত করেছে। পুরুষের এই সমাজে নারীর পদে পদে বিপত্তি, মন্দির মসজিদ তাদের কোনও সমস্যারই সমাধান করবে না।
হিন্দু কট্টরপন্থিরা বলছে, সুপ্রিম কোর্টের কোনও অধিকার নেই হিন্দু ধর্মের রীতিনীতি বদলে দেওয়ার, শবরীমালার নারী-নিষেধকে ভেঙে দেওয়ার। কিন্তু এতে একটি প্রশ্ন আছে, তুমি যদি হিন্দু ধর্মে নাক গলানো না চাও, তাহলে তো তুমি মুসলিমদের ধর্মেও নাক গলাতে পারো না। মুসলিমরাও চায় না তাদের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রস্তাব কেউ করুক। হিন্দু আর মুসলিমে মূলত কোনও পার্থক্য নেই। আজ মুসলমানরা যা করছে, হিন্দুরা মুসলমান হলে একই কাজ করতো। আজ হিন্দুরা যা করছে, মুসলমানরা হিন্দু হলে ঠিক একই কাজ করতো। সবচেয়ে ভালো, ধর্ম পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ওঠা। অহরহই বিবর্তন হচ্ছে সব কিছুর, সমাজ পাল্টে যাচ্ছে, নারীবিদ্বেষী মানসিকতা ধীরে ধীরে সংশোধিত হচ্ছে, এ সময় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তারা যে করেই হোক আঁকড়ে রাখতে চায় তাদের আদি নারীবিদ্বেষ। এই নারীবিদ্বেষকে তারা, ট্রাডিশন, বলে ডাকে। সব ট্রাডিশনই সভ্য সমাজের জন্য উপযুক্ত নয়। আজও তারা বিবর্তিত না হলে ইতিহাসই সাক্ষী থাকবে তাদের নারীবিদ্বেষিতার, তাদেরই মুখ নত হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে। প্রতিটি দেশই, যে দেশই সভ্য হয়েছে, ধর্মের সংস্কার করেছে। যাজকদের হাত থেকে কেড়ে নিতে হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা। যাজক, পুরোহিত, রাব্বাই, পীর, বাবাÑ এদের কাজই হলো ধর্ম যে অবস্থায় হাজার বছর আগে ছিল, ধর্মকে সে অবস্থাতেই রেখে দেওয়া। সভ্যতা, উদারতা, আধুনিকতার স্পর্শ যেন না লাগে ধর্মে। স্পর্শ লাগলে, ধর্মের রক্ষকরা ভয় পায়, তারা না আবার মূল্যহীন হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষকে ঈশ্বর আর কুসংস্কারের অন্ধকারে ঢেকে যতদিন বোকা বানিয়ে রাখা যায়, ততদিনই তাদের লাভ।
ধর্ম থেকে নৃশংসতা আর বর্বরতা দূর করার দায়িত্ব সব কালেই নিয়েছে গুটিকয় মুক্তবুদ্ধির মানুষ। একসময় শাসকদের মধ্যেও ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চা। দুঃখ এই, শাসকেরা আজকাল, ধর্ম যে গণতন্ত্র বিরোধী, মানবতাবিরোধী, নারী বিরোধী, বাকস্বাধীনতা বিরোধী… তা জেনেও ধর্মের গুণগান গাইতে থাকেন, একে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করেন না। ভারতবর্ষ যদি সেক্যুলার রাষ্ট্র হয়, সেই রাষ্ট্রে কোনও ধর্মীয় আইন বহাল থাকতে পারে না। সমানাধিকারের ভিত্তিতে আইন তৈরি হবে, যে আইন সবার জন্য, হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান বৌদ্ধ ইহুদিÑ সবার জন্য এক আইন।
মেয়েরা মন্দির গির্জায় প্যাগোডায় যাওয়ার স্বাধীনতা যদি না পায়, না পাক। আমি মনে করি না এতে তাদের খুব ক্ষতি হবে। ঈশ্বর, ভগবান বা প্রভু জাতীয়রা পুরুষের জাত। নারীকে তারা চিরকালই ঘৃণা করেছে। সবচেয়ে বেশি মেয়েদের জন্য যা দরকার, তা হলো ধর্মীয় আইন থেকে তাদের মুক্তি, পুরুষতন্ত্রের বর্বরতা থেকে মুক্তি, দরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বনির্ভরতা। এসবের জন্য যে লড়াইটা করা দরকার, সেই লড়াই শবরীমালায় বা দরগা শরীফে প্রবেশের চেয়ে লক্ষ গুণে জরুরি।