করোনায় মানুষের পাশে ৬২ জেলায় সেনাবাহিনী

জুলাই ২৬ ২০২০, ১৩:৫৯

Spread the love
 আগমনী ডেস্কঃকরোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও কর্মবিচ্যুত সাধারণ মানুষের পাশে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এক অন্যরকম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। ২৫ মার্চ থেকে চার মাস ধরে দেশের ৬২ জেলায় ৫৫০টি টিমের মাধ্যমে প্রতিদিন ৭ হাজার সেনাসদস্য মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্বের দেশে দেশে শান্তিরক্ষা মিশনে পুনর্বাসন ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সেনাসদস্যরা মাথায় ত্রাণের বোঝা নিয়ে দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছে সেনাবাহিনী।

মাঠ পর্যায়ে সেনাবাহিনী ২৪ হাজারের বেশি গরিব কৃষককে বিনামূল্যে দিয়েছে বিভিন্ন প্রকার কৃষিবীজ। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের অংশ হিসেবে ৯ জুন থেকে এক মাস ১৩ হাজার ৬৬৪ জন গর্ভবতী মায়ের গর্ভকালীন চিকিৎসাসেবা দিয়েছে। পাশাপাশি বিদেশ প্রত্যাগতদের কোয়ারেন্টাইনে থাকা নিশ্চিত করা, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা ও হাটবাজারসহ জনবহুল স্থানে সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়েছেন সেনাসদস্যরা। বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ জন সেনাসদস্যের সমন্বয়ে গঠিত ৪৫০টি দল করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ওই ৬২ জেলায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। করোনা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুদ্ধ ঘোষণা করার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই যুদ্ধে সর্বতোভাবে নিয়োজিত রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের সার্বিক নির্দেশনায় সেনাসদস্যরা নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে ‘অপারেশন কভিড শিল্ড’ নামে করোনা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। ঝুঁকিপূর্র্ণ এ কাজে নিয়োজিত থাকতে গিয়ে গত সপ্তাহ পর্যন্ত ৩ হাজার ৩৩৮ জন সেনাসদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।মারা গেছেন ৮ জন। সেনাবাহিনী প্রধান দেশের এই ক্রান্তিকালে সেনাবাহিনীকে জনগণের সেবায় নিয়োজিত করায় ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুতেই করোনা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে সেনাবাহিনীর সব সদস্যের এক দিনের বেতনের পাশাপাশি সেনাকল্যাণ সংস্থা, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, বাংলাদেশ ডিজেল প্ল্যান্ট এবং ট্রাস্ট ব্যাংকের পক্ষ থেকে মোট ২৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়।সেনাসদরের তথ্যমতে, করোনা সংক্রমণের শুরুতেই রাজধানীর আশকোনা হজক্যাম্প ও উত্তরা দিয়াবাড়ী সংলগ্ন রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দুটি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার স্থাপিত হয়। বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের প্রয়োজনীয় স্ক্রিনিং সম্পন্নের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গকে সেনাবাহিনীর কাছে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনী এসব যাত্রীকে বিমানবন্দর থেকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া, তাদের ডিজিটাল ডাটা এন্ট্রি এবং কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে থাকাকালীন খাবার, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক সেবা দিচ্ছে। মহাখালীতেও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটি আইসোলেশন সেন্টার উদ্বোধনের অপেক্ষায়।

করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনে জনজীবন যখন স্থবির হয়ে পড়েছিল, তখন অসহায় ও দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সেনাবাহিনী। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজেদের উদ্বৃত্ত রেশন নিয়ে রাতের আঁধারে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন সেনাসদস্যরা। হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে নিয়মিতভাবে অসহায় ও দুস্থ মানুষের বাড়ি বাড়ি ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন সেনাসদস্যরা।

দেশের বিভিন্ন জেলায় কর্মহীন গরিব ও অসহায় মানুষের মাঝে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছে দিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আয়োজন করা হয়েছে ‘এক মিনিটের বাজার’, ‘সম্প্রীতির বাজার’, ‘সেনাবাজার’। ঈদুল ফিতরের আগে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ও কাঁচাবাজার ছাড়াও এসব বাজারের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ঈদ উপহার হিসেবে কাপড়-চোপড়ও দেওয়া হয়। পবিত্র রমজানের মধ্যে অসহায় দুস্থ ও নিম্নআয়ের পরিবারকে বিনামূল্যে ইফতার প্রদান করতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল ‘সম্প্রীতির ইফতার’। সেনাবাহিনী নিজস্ব ও সরকারি ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসামরিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছে।সেনাবাহিনী নিয়মিতভাবে সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিষয়টি বোঝানোর পাশাপাশি তাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে উদ্বুব্ধ করেছে। শহর-গ্রামসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সেনা সদস্যরা বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়সহ হাটবাজারে সাধারণ মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এবং মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে উৎসাহিত করছে। সেনাবাহিনী সাধারণ জনগণের মধ্যে বিনামূল্যে পর্যাপ্ত মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করেছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় নিয়মিতভাবে জীবাণুনাশক ¯ন্ডেপ্র করার পাশাপাশি জীবাণুমুক্তকরণ টানেল স্থাপন করেছে।

লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক কৃষকদের সহায়তা দিতে সেনাবাহিনী সরাসরি তাদের কাছ থেকে সবজি কিনে নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে এসব সবজি ত্রাণসামগ্রী হিসেবে প্রায় ১৭ হাজার অসহায় ও দুস্থ পরিবারের মাঝেও বিতরণ করে। ফলে অসহায় মানুষের পাশাপাশি কৃষকরাও তাদের সবজির ন্যায্যমূল্য পেয়ে উপকৃত হয়েছে। এ ছাড়াও ২৪ হাজারের বেশি গরিব কৃষকের মাঝে সেনাবাহিনী বিনামূল্যে বিভিন্ন ধরনের কৃষি বীজ বিতরণ করেছে। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরপরই অসহায় ও দুস্থ মানুষের মাঝে জরুরি ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করেছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী তাদের নিজস্ব চিকিৎসক দলের মাধ্যমে ৬২ জেলায় ৩৮ হাজার ২৭৯ জন অসহায় ও দুস্থ মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও জরুরি ওষুধ দিয়েছে। ১৩ হাজার ৬৬৪ জন গর্ভবতী মাকে গর্ভকালীন চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি করোনাভাইরাসের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ায় ৫৯ জন গর্ভবতী মায়ের নমুনা পরীক্ষা করে ৩ জন করোনা শনাক্ত হওয়ায় তাদের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়াও ২ হাজার ৮৮৪ জন গর্ভবতী মায়ের রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। অসহায় মানুষের মাঝে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি করোনায় আক্রান্ত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঢাকা সিএমএইচসহ সকল সেনানিবাসের সিএমএইচে সশস্ত্র বাহিনীর প্রাধিকৃত সদস্য ও তাদের পরিবারবর্গের করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজিতে ৩টি এবং অন্যান্য সেনানিবাসে অবস্থিত সিএমএইচে ১০টি আরটি-পিসিআর মেশিন স্থাপিত হয়েছে। করোনার প্রকোপে লকডাউনের সময় নিয়মিতভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসহায় মানুষের সহায়তার জন্য ত্রাণসামগ্রী ও সেনানিবাসগুলোর জন্য জরুরি চিকিৎসাসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে সেনাবাহিনীর আর্মি এভিয়েশন গ্রুপ। বেসামরিক প্রশাসনের অনুরোধে আর্মি এভিয়েশনের হেলিকপ্টারে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণসামগ্রী নিয়মিত পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও সেনাবাহিনী প্রধানের নির্দেশে জরুরি পরিস্থিতিতে সহায়তা দিতে আর্মি এভিয়েশন গ্রুপের তিনটি এমআই হেলিকপ্টার ও একটি কাসা সি-২৯৫ বিমান সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রয়েছে। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে জরুরি রোগী পরিবহনের জন্য সেনাবাহিনীর আরও দুটি হেলিকপ্টারকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের সুবিধা সংযুক্ত করে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দেশপ্রেমিক সেনাসদস্যরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের দীর্ঘ ৩২ বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জাতির এই ক্রান্তিকালে দেশের ৬২ জেলায় প্রতিদিন ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে সক্রিয় রয়েছেন।

 

 

 

 

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও