দুর্নীতির আখড়া রূপগঞ্জের ভূমি অফিস

জানুয়ারি ০৯ ২০২২, ১৫:১৭

Spread the love
নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জঃ দুর্ণীতির আখড়ায় পরিনত হয়েছে রূপগঞ্জের ভ’মি অফিসগুলো। আর এ দুর্ণীীতর বরপুত্র হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্তাব্যক্তিসহ কর্মচারীরা। প্রতিনিয়তই হয়রানির শিকার হচ্ছে রূপগঞ্জের মানুষ। তারপরও দেখার কেউ নেই। স্থানীয় প্রভাবশালী ও ভ’মি অফিসের কর্মকর্তারা সবায় মিলে রূপগঞ্জবাসীকে ভুমিহীন করার মহাপরিকল্পনায় নেমেছেন। ভ’মি অফিসগুলো হাউজিং কোম্পানীগুলোর এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন।
রূপগঞ্জ এসিল্যান্ড আতিকুলের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দূর্ণীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন সেবা গ্রহীতারা। উৎকোচের টাকা ছাড়া সেবা পাচ্ছে না জমি মালিকরা। নামজারী ও মিস কেসের নামে চলছে সীমাহীন দূর্ণীতি আর মোটা অংকের ঘুষ বানিজ্য। সরকারী নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এসিল্যান্ডের নিজস্ব আইনে চলছে ভূমি অফিস। দিনদিন এসিল্যান্ডের অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন জমি মালিকগণ। এসিল্যান্ডের উৎকোচের দাবি পূরণে অসমর্থ হলেই টেবিলে আটকে রাখা হচ্ছে নামজারী নথি।
সরেজমিনে ঘুড়ে জানা যায়, রূপগঞ্জ উপজেলায় ৯টি ইউনিয়ন ভূমি অফিস রয়েছে। অফিগুলোতে খোজ খবর নিলে বেড়িয়ে আসে ঘুষ, দুর্ণীতি আর অনিয়মের চিত্র । নামজারীর আবেদন থেকে শুরু করে নামজারীর প্রস্তাব, সার্ভে রিপোর্ট, নামজারি, ডিসিআর সংগ্রহ করে নামজারী সম্পন্ন করাসহ সব কিছুতেই ঘুষ আর ঘুষ। এসিল্যান্ডের ঘুষের সাংকেতিক চিহ্ন হচ্ছে (এল আর)। সরকারি হিসাবে ৩৩ শতাংশে এক বিঘা। রূপগঞ্জ ভুমি অফিসে চলে এসিল্যান্ডের বেঁধে দেওয়া আইন। এখানে ২৫ শতাংশে এক বিঘা, ৪০ শতাংশে ২ বিঘা, ৬০ শতাংশে তিন বিঘা, ৮০ শতাংশে ৪ বিঘা ও ১০০ শতাংশে ৫ বিঘা হারে এসিল্যান্ড তার ঘুষের অংক বসান। সেই হারে ঘুষের টাকা দিলে নামজারী হয়। আর টাকা না দিতে পারলে নামজারী ফাইল পরে থাকে মাসরে পর মাস।
মিস কেসের ক্ষেত্রে মিলেছে ভিন্ন রকম তথ্য, কেউ মিস কেছ করে ৪/৫ বছর ধরে ধরনা দিচ্ছেন এসিল্যান্ড অফিসে। কিন্তু কোন সুরহা পাচ্ছেন না।
এ ব্যপারে ভুক্তভোগী আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি ২০১৬ সাল থেকে মিস কেছ নিয়ে ভুমি অফিসে ঘুরতেছি। আমার কেসের কোন রায় দিচ্ছেনা। কারন হিসাকে জানতে চাইলে বলেন, আমার কাছে ১ লক্ষ টাকা দাবী করে। আমি টাকা দিতে পারিনি তাই আমার কেসের রায় হয়না।ইছাখালী এলাকার বৃদ্ধা খাদিজা বেগম (৭০) অভিযোগ করে বলেন, ২০০৬ সালে পূবগাও মৌজায় তার নামে ৬ শতাংশ জমি তিনি নামজারী করেন। ২০১৮ইং সালে বিনা নোটিসে তার নামজারী কর্তন করা হয় বলে তিনি অভিযোগ করেন।
উপজেলা ভুমি অফিসের প্রধান ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই নামজারী সর্ম্পকিত তথ্যবহুল বড় বড় ব্যানার বা লিফলেট চোখে ভেসে উঠবে । সেখানে লিখা রয়েছে বিভিন্ন প্রকার সেবা দেয়ার কথা। লিফলেটে লেখা রয়েছে আবেদনের জন্য কোর্ট ফি ২০ টাকা, নোটিস জারি ফি ৫০ টাকা, রেকর্ড সংশোধন বা হালকরন ফি ১০০০ টাকা ও প্রতি কপি মিউটেশন খতিয়ান ফি ১০০ টাকা। সব মিলিয়ে ১১৭০ টাকা। কিন্তু ব্যানার বা লিফলেটে দেয়া নির্দেশাবলী ব্যানার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। খোঁজ নিয়ে মিলেছে ভিন্ন রকম তথ্য। প্রতিটি ডিসিআরের জন্য নেয়া হচ্ছে সর্বনিম্ন ১ হাজার ৭শ’ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। অভিযুক্ত কর্মকর্তা প্রতি পর্চা ও ডিসিআর স্বাক্ষর করতে ২শ’ টাকা নিয়ে থাকেন ।
ভুমি অফিসের এক ঘনিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, জেনারেল খারিজের ক্ষেত্রে এখানে ২৫ শতাংশে বিঘা হিসাবে নামজারী করতে এসিল্যান্ড নেন ২ হাজার টাকা এলআর নামক ঘুষ। তাহলে ১শ’ শতাংশে এসিল্যান্ড আতিকুল ইসলাম নিচ্ছেন ১০ হাজার টাকা। প্রতি বছর রূপগঞ্জ উপজেলা ভুমি অফিসে নামজারী আবেদন হয় প্রায় ২৫ হাজার। সেখান থেকে নামজারী অনুমোদন হয় প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার। এর মধ্যে সাধারণ হিসাবে অভিযুক্ত এসিল্যান্ড হাতিয়ে নিচ্ছেন ২ থেকে আড়াই কোটি টাকা। পূর্বাচল প্লটের এলআর হচ্ছে কাঠা ভিত্তিক। ৩ কাঠার প্লট অনুমোদন দিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তা নিচ্ছেন সাড়ে ৩ হাজার, ৫ কাঠা নিচ্ছেন সাড়ে ৪ হাজার, ৭ কাঠা নিচ্ছেন ৬ হাজার ও ১০ কাঠার প্লট নিচ্ছেন সাড়ে ৭ হাজার টাকা। প্রতি বছর প্লটের নামজারী অনুমোদন হয় প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার। পূর্বাচল উপশহরের প্লটের নামজারী করে এসিল্যান্ড নিচ্ছেন প্রায় ৩ কোটি টাকা।
‘খ’ তফসিল জমির ক্ষেত্রে সরকার ২০১৩ সালে এক প্রজ্ঞাপনে অবমুক্তির একটি আদেশ দেন। সেই ‘খ’ তফসিল জমি ১ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত খারিজ করতে এসিল্যান্ড ঘুষ নেন ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা, ১ থেকে ১৫ শতাংশ খারিজ করতে নেন ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা, ১ থেকে ৩০ শতাংশ নেন ৪৫ থেকে ৬৫ হাজার টাকা, ১ থেকে ৫০ শতাংশ নেন ৭৫ থেকে ১ লাখ টাকা, ১ থেকে ৭৫ শতাংশ নেন ১ থেকে দেড় লাখ টাকা ও ১ থেকে ১শ’ শতাংশ নেন দেড় থেকে ২ লাখ টাকা। কাগজপত্রের একটু গড়মিল হলে এক বিঘা খারিজ করতেই নেন ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। পার্ট ভিপি নামজারীর ক্ষেত্রে একই হারে ঘুষ নেন এসিল্যান্ড আতিকুল ইসলাম। সে হিসাবে খ তফসিল আর মিস কেস থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা।
এ ঘুষের টাকা তিনি তার অধিনস্থ কর্মচারীদের মাধ্যমে আদায় করে থাকেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী জানান, আমরা স্যারের অধীনে কাজ করি। স্যারের নির্দেশ আমাদের পালন করতে হয়। স্যারের নির্দেশ পালন না করে কি অফিসে কাজ করতে পারবো?দাউদপুর ইউনিয়নের কাইয়ূম বঙ্গবাসী, তায়েব আলী মোল্লা, মোতাহার হোসেন ও মামুন মিয়াসহ বেশ কয়েকজন জমির মালিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দাউদপুর ইউনিয়নের কুলিয়াদী, দেবগ্রাম, হিরনাল, লক্ষাশিমুলিয়া, শিমুলতলা, রঘুরামপুর মৌজার নামজারী এসিল্যান্ড তার নিজস্ব ক্ষমতাবলে বন্ধ রেখেছেন। পুরো উপজেলায় চাউর উঠেছে ৬ মৌজার খারিজ বন্ধ। কিন্তু না, ঘুষখোর কর্মকর্তার সাথে রফাদফা হলে শতাংশ প্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে খারিজ করে দেন। দাউদপুর এলাবাসীর অভিযোগ করে বলেন আমরা আমাদের বাব দাদার ভিটে বাড়ি খারিজ করতে পারিনা। এসিল্যান্ড কোন ক্ষমতার বলে খারিজ বন্ধ রেখেছে আমরা এ প্রতিকার চাই। এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের শেষ নেই।
এ বিষয়ে দাউদপুর ইউনিয়ন উপ-সহকারী কর্মকর্তা মুজিবুর রহমানের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসিল্যান্ড স্যারের নির্দেশ তাই এই ছয়টি মৌজার প্রস্তাব দেওয়া বন্ধ রয়েছে।
রূপগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিকুল ইসলামের বিরেুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নামজারী করতে সরকারী ফি ১১৭০ টাকার বেশী নেওয়া হয়না। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন দাউদপুর ইউনিয়নের কোন মৌজায় নামজারী বন্ধ করা হয়নি। কাগজপত্র সঠিক থাকলে নামজারী হচ্ছে।নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ছয় মৌজায় নামজারী বন্ধ রাখা সম্পূর্ণ বে-আইনী। লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও