এমপিদের ‘পালানোর দরজা’ ও আবদুল কাদেরের সত্যভাষণঃসোহরাব হোসেন

জানুয়ারি ০৬ ২০২১, ০৮:৫৭

Spread the love

তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে আসা আবদুল কাদের মির্জা কেবল আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা নন, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আপন ছোট ভাই। ৩১ ডিসেম্বর বসুরহাট পৌরভবন চত্বরে নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণাকালে আবদুল কাদের মির্জা বলেছেন, ‘বৃহত্তর নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের কিছু কিছু চামচা নেতা আছেন, যাঁরা বলেন অমুক নেতা, তমুক নেতার নেতৃত্বে বিএনপির দুর্গ ভেঙেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে তিন-চারটা আসন ছাড়া বাকি আসনে আমাদের এমপিরা দরজা খুঁজে পাবে না পালানোর জন্য। এটাই হলো সত্য কথা। সত্য কথা বলতে হবে। আমি সাহস করে সত্য কথা বলছি।’

আবদুল কাদের মির্জার এ বক্তব্যের ভিডিও ফেসবুক ও ইউটিউবে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় দলীয় কিছু নেতাকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ‘নোয়াখালীর মানুষজন বলে, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এটা সত্য। কিন্তু আপনাদের (নোয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেতা) জনপ্রিয়তা বাড়েনি। আপনারা প্রতিদিন ভোট কমান। টাকা দিয়ে বড় জনসভা করা, মিছিল করা কোনো ব্যাপার নয়। টাকা দিলে, গাড়ি দিলে আমিও অনেক লোক জড়ো করতে পারব। না হয় রাজনীতি থেকে বিদায় নেব।’

১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে আবদুল কাদের মির্জা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভার মেয়র পদে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।

নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সহসভাপতি আবদুল কাদের মির্জা তাঁর বক্তৃতায় আরও বলেন, ‘নোয়াখালীর রাজনীতি অতি কষ্টের। এই বৃহত্তর নোয়াখালীতে আমাদের নেতা ওবায়দুল কাদের, মওদুদ সাহেব (বিএনপির মওদুদ আহমদ), আবু নাছের সাহেব (জামায়াতের)—এই তিনজন ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ, তাঁদের সমমর্যাদার কেউ নেই। কোনো নেতা সৃষ্টি হয়নি। এখন তো ওবায়দুল কাদের, মওদুদ আহমদের নাম বিক্রি করি। তাঁরা তিনজন তো অসুস্থ, তাঁরা মারা গেলে কার নাম বিক্রি করবেন, কেউ নাই।’

কারও নাম উল্লেখ না করে আবদুল কাদের বলেন, ‘প্রকাশ্য দিবালোকে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেন, তাঁরা হচ্ছেন নেতা। টেন্ডারবাজি করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট যাঁরা করেন, তাঁরা হচ্ছেন নেতা। পুলিশের, প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি দিয়ে যাঁরা পাঁচ লাখ টাকা নেন, তাঁরা হচ্ছেন নেতা। গরিব পিয়নের চাকরি দিয়ে তিন লাখ টাকা যাঁরা নেন, তাঁরা হচ্ছেন নেতা।’

‘প্রকাশ্য দিবালোকে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেন, তাঁরা হচ্ছেন নেতা। টেন্ডারবাজি করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট যাঁরা করেন, তাঁরা হচ্ছেন নেতা। পুলিশের, প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি দিয়ে যাঁরা পাঁচ লাখ টাকা নেন, তাঁরা হচ্ছেন নেতা। গরিব পিয়নের চাকরি দিয়ে তিন লাখ টাকা যাঁরা নেন, তাঁরা হচ্ছেন নেতা।’

বৃহত্তর নোয়াখালীতে কারা প্রকাশ্য দিবালোকে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেছেন, সে কথা সবার জানা। টেন্ডারবাজি করে কারা কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন, তা-ও মানুষের মুখে মুখে। এত দিন মানুষ আড়ালে আবডালে কথাগুলো বললেও আবদুল কাদের প্রকাশ্যে বলেছেন। এ জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতে পারেন।

জেলা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটির সমালোচনা করে আবদুল কাদের বলেন, ‘সাবেক সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের ছোট ভাই জাবেদ (মিনহাজ আহমেদ জাবেদ)। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো কোনো নেতা তখন (এক-এগারোর সময়কালে) নিজেদের রক্ষা করেছেন। এখন সেই জাবেদ এবং হাওয়া ভবনের মানিক (আতাউর রহমান ভূঁইয়া ওরফে মানিক) আজ জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। অথচ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিনের মতো ত্যাগী ও নির্যাতিত ব্যক্তিকে করা হয়েছে উপদেষ্টা। এটা হলো আমাদের কমিটি।’

আওয়ামী লীগের নেতারা দুরবিন দিয়ে অনুপ্রবেশকারী খোঁজেন, কিন্তু আবদুল কাদের তাঁর এলাকার অনুপ্রবেশকারী কারা, তা খোলসা করেছেন। প্রতিটি উপজেলা ও জেলায় এভাবে আওয়ামী লীগ নেতারা সত্যভাষী হলে অনুপ্রবেশকারী খুঁজে বের করা কঠিন হতো না। আসলে যাঁরা অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তারা অনুপ্রবেশকারী খুঁজে পাবেন কীভাবে?

ওই বক্তব্যের পর রোববার উপজেলা পরিষদের সভাকক্ষে নির্বাচনী আচরণবিধি প্রতিপালন বিষয়ে মতবিনিময় সভায় আবদুল কাদের যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটিও এখন ভাইরাল। কী প্রেক্ষাপটে আবদুল কাদের মির্জা এই বক্তব্য দিয়েছেন, সে সম্পর্কে কৌতূহলোদ্দীপক মন্তব্য পাওয়া গেছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খিজির হায়াত খান গণমাধ্যমকে বলেন, কিছুদিন আগে আবদুল কাদের মির্জা চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি শপথ করেছেন, দেশে ফিরে সত্য কথা বলবেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। সে শপথের অংশ হিসেবেই তিনি এসব বলছেন।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেছেন, আবদুল কাদের মির্জা সত্য কথাই বলেছেন। তিনিও ব্যক্তিগতভাবে এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত। পৌরসভা নির্বাচনের পর দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন। অন্যদিকে আবদুল কাদের মির্জা প্রথম আলোকে বলেছেন, এই বক্তব্য দেওয়ার পর নানা মহল থেকে তাঁর ওপর চাপ এসেছে। তবে তিনি চান নির্বাচন সুষ্ঠু হোক। তাতে যদি তিনি একটি ভোটও না পান, কিছু মনে করবেন না। কিন্তু জোরজবরদস্তি করে জিততে চান না আওয়ামী লীগের এই নেতা।

উল্লেখ্য, আবদুল কাদের মির্জা স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়। তিনি দুই মেয়াদে পৌরসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে এলাকার অনেক উন্নয়ন করেছেন। তাঁর মতো মনোভাব নিয়ে যদি সব দলের সব প্রার্থী নির্বাচন করতেন, তাতে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত হতো, গণতন্ত্র রক্ষা পেত।

আওয়ামী লীগের যেসব নীতিনির্ধারক নির্বাচন সম্পর্কে বিরোধী দলের সমালোচনাকে বিএনপি-জামায়াত চক্রের অপপ্রচার বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চান, তারা আবদুল কাদেরের কথাগুলো আমলে নেবেন আশা করি। তিনি বিএনপি-জামায়াত চক্রের কেউ নন। তিনি যখন সত্য কথা বলার শপথ নিয়েছেন, তখন তাঁকে সাধুবাদ জানাই। তাঁর এই সত্যভাষণ আওয়ামী লীগের জন্য ‘ওয়েক আপ কল’ হোক। তাতে গণতন্ত্র না বাঁচলেও অন্তত নির্বাচনের নামে প্রহসন বন্ধ হবে। উৎসঃপ্রথম আলো
লেখকঃসোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও