রাজ্যহারা রাজপুত্রের প্রত্যাবর্তন

অক্টোবর ২৭ ২০১৮, ১৯:০৬

Spread the love
প্রায় ৬০ বছর পর রাজপুত্র এলেন রাজবাড়িতে। রাজ্য নেই, শুধু আছে শৈশবের স্মৃতি। তাই নিয়ে রাজপুত্র একবার ছুটে যান রাজবাড়ির পুকুরঘাটে। আবার উঠে আসেন দোল মন্দিরের সিঁড়িতে। এত দিন যাঁরা রাজশাহীর পুঠিয়ার রাজবাড়ি দেখে বড় হয়েছেন, তাঁরা স্বয়ং রাজার ছেলেকে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। রাজপুত্রকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয় নাট্য সংগঠন পুঠিয়া থিয়েটার। পুঠিয়া রাজবংশের দ্বাদশ বংশধর যতীন্দ্র রায় চৌধুরীর ছেলে জগৎ নারায়ণ রায় চৌধুরী এসেছিলেন জন্মভিটায়। সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর ছেলে রজত রায় চৌধুরী ও পুত্রবধূ উজ্জয়িনী ঘোষ চৌধুরী।

বিমলা চরণ মৈত্রের লেখা পুঠিয়া রাজবাড়ি বইতে দেখা যায়, পুঠিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বৎসাচার্য। তাঁর থেকে শুরু করে রাজবংশের ষষ্ঠতম পুরুষ ছিলেন দর্পনারায়ণ। তিনি পরে চৌপুখুরিয়া রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই দর্পনারায়ণের পরে এবং চৌপুখুরিয়া রাজবংশের ষষ্ঠ এবং শেষ পুরুষ ছিলেন যতীন্দ্র রায় চৌধুরী।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে মহারানি হেমন্ত কুমারী দেবী পুঠিয়া রাজবাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে রাজবাড়ি ছেড়ে ভারতে চলে যান বাসিন্দারা। বর্তমানে স্থাপনাগুলো দেখভাল করছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।

রাজবাড়ির ফটকেরাজবাড়ির ফটকেস্মৃতি যেন প্রাণ পেল
রাজপরিবারের সদস্যরা কলকাতা থেকে পুঠিয়ার উদ্দেশে বাংলাদেশে রওনা দিয়েছিলেন ১২ অক্টোবর। ঢাকা ও রাজশাহী হয়ে পরদিন দুপুর ১২টায় পৌঁছান পুঠিয়া রাজবাড়িতে। রাজবাড়ি পরিদর্শনের সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন পুঠিয়া থিয়েটারের সভাপতি ও বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সহসভাপতি কাজী সাঈদ হোসেন। তিনি বললেন, ‘জগৎ নারায়ণ রায় চৌধুরী পুঠিয়ায় এসে খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। অনেকবার কেঁদেছেন। ছোটবেলায় কোথায় স্নান করতেন, সেই ঘাট চিনতে পারলেন। মূল রাজবাড়ির কোন অংশ বিচারকাজের আর কোন অংশ কৃষির জন্য ছিল, তা দেখালেন। সামনের মাঠটা তখন ফুলবাগান ছিল তা–ও বললেন।’ সেদিন তাঁদেরই পছন্দ অনুযায়ী ১৬ রকম তরকারি দিয়ে ভোগ রান্না করা হয়। এলাকার লোকজনের সঙ্গে বসে তাঁরা খাওয়াদাওয়া করেন। সাঈদ হোসেন বলেন, ‘তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। এবার ছেলে সঙ্গে এসেছেন। তাই তিনি আবার পুঠিয়ায় আসতে চান মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে।’

এখানেই এক পুকুর ছিল
রাজশাহী শহরের একটি হোটেলে উঠেছিলেন রাজপরিবারের সদস্যরা। ১৭ অক্টোবর সকালেই গিয়েছিলাম দেখা করতে। কলকাতায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তাঁরা। জগৎ নারায়ণ রায় চৌধুরীর কথায় অতীত প্রাণ পেল। রাজশাহী শহরে থাকলেও ছোটবেলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে পরিবারের সঙ্গে পুঠিয়ার রাজবাড়িতে যেতেন জগৎ নারায়ণ। সেই সব স্মৃতি এখনো মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে যেন। তিনি বললেন, ‘ছেলেকে বলেছিলাম চল, রাজবাড়িটা একবার দেখে আসি। আর আমার ছোটবেলার শহরটা তোকে দেখিয়ে নিয়ে আসব। কোথায় বড় হয়েছি। কী রকম সেই শহরটা।’

তিনি বলে যাচ্ছিলেন, ‘আগে সব রাজাদেরই রাজশাহী শহরে একটা বাড়ি ছিল। আমাদেরও ছিল। রানিবাজারে। রাজশাহী নগরের অলকা হল থেকে ষষ্ঠীতলার দিকে যেতে হাতের বাঁয়ে একটা পুকুর ছিল। এর পাশেই ৪২ কাঠা জায়গার ওপরে বাড়ি ছিল। পুকুরের তিনটি ঘাট ছিল। একটি রাজপরিবারের স্নানের জন্য, অপর দুটির একটি ছিল ছেলেদের আরেকটি ছিল মেয়েদের।’

তবে সেসবের কোনো স্মৃতিচিহ্নই এখন আর নেই। তাই হতাশ কণ্ঠে বললেন, ‘বড় আশা করে ছেলেকে দেখানোর জন্য নিয়ে এলাম কিন্তু সেই পুকুর আর বাড়ির কোনো চিহ্নই খুঁজে বের করতে পারলাম না। শুধু বাড়িটার পাশ দিয়ে একটা বড় ড্রেন ছিল। সেটাই শনাক্ত করতে পারলাম।’ স্থানীয় লোকজনের কাছেও জানতে চেয়েছেন কখন কীভাবে এত পরিবর্তন হলো। অনেকেই জানিয়েছেন, পুকুর ভরাট করে প্লট করে সব বাড়িঘর করা হয়েছে। জগৎ নারায়ণ রায় চৌধুরী বলেন, ‘ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে গানের আসর বসত। সেখানে প্রখ্যাত সরোদবাদক রাধিকা মোহন মৈত্র কতবার যে এসেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তাঁদের বাড়িটাও ঠিক লাগাতে পারলাম না। অক্ষয় কুমার মৈত্র ও স্যার যদুনাথ সরকারের বাড়িটার গলিও বের করতে পারলাম না। সব বদলে গেছে। অবশ্য বড় মসজিদের পাশে “মেডিসিন হাউস” নামের বাড়িটা ঠিক পেলাম। ওটা ওই রকমই আছে।’

পুঠিয়া থিয়েটারের শুভেচ্ছাপুঠিয়া থিয়েটারের শুভেচ্ছারাজশাহীতে এসে স্মৃতির স্মারক খুঁজে, কাঙ্ক্ষিত মানুষদের কার দেখা পেলেন—সেসবই উঠে আসছিল তাঁর কথা। বলছিলেন, ‘আমি বি বি হিন্দু একাডেমিতে (রাজশাহী ভোলানাথ বিশ্বেশ্বর হিন্দু একাডেমি) পড়তাম। সেখানে গেলাম। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা হলো। অনেক ছবি তোলা হলো। আমাদের সময় কোনো মেয়ে ছিল না। এখন দেখলাম অনেক মেয়ে। মেয়েদের সঙ্গেও ছবি তুললাম। যখন দেশ ছেড়ে যাই তখন সিঅ্যান্ডবির সহকারী প্রকৌশলী ছিলাম। বয়স তখন প্রায় ২২ বছর। কিন্তু সিঅ্যান্ডবি মোড়টাও চিনে উঠতে পারলাম না।’

এক কাপড়ে দেশ ছেড়েছিলেন
১৯৫৯ সাল। বদলে যাওয়া সময় তখন। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় টিকতে না পেরে জগৎ নারায়ণ রায় চৌধুরীরা দেশ ছেড়ে চলে যান ভারতে। সে  যাত্রায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাবা, মা, ভাই ও ভাবি। বললেন, ‘প্রায় এক কাপড়ে আমরা বের হয়ে চলে যাই।’

তাঁর বয়স এখন ৮৪ বছর। বয়স বেড়েছে। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিগুলো ডানা ঝাপটাচ্ছিল যেন। ছেলে রজত রায় চৌধুরী বললেন, ‘বাবা মাঝেমধ্যেই জন্মভিটাটা দেখে যাওয়ার কথা বলেন। তাই নিয়ে এলাম। রাজবাড়িতে গিয়ে যেখানে সেখানে বাবা দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন। সবই যেন তাঁর চেনা। কাজী সাঈদ ভাই বলার আগেই কোথায় কী ছিল বাবা বলে দিচ্ছিলেন। যেমন ঘাটের এখন  ওপরে এখন   কোনো ছাদ নেই। বাবা বললেন, ওটার ওপরে একটা ছাদ ছিল।’ তাঁর বাবা ঘুরলেন রজত রায় চৌধুরী সেসব স্মৃতি করলেন ক্যামেরাবন্দী। কে জানে আবার কখন ফিরবেন তাঁরা। তবে পুঠিয়া রাজবাড়ি ছেড়ে আসার সময় অনেক মানুষ তাঁদের বিদায় দিতে এসেছিল। অতিথি হয়ে আসা রাজপরিবারের আদি বাসিন্দাদের সঙ্গে তাঁরাও যেন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও