সাবেক এক পুলিশ কর্মকর্তার বিধবা স্ত্রী তার মেয়ে অপহরণের বিচার চাইতে থানায় যাওয়ায় পুলিশ সদস্য জাহিদ বৃদ্ধার গালে সিগারেটের আগুনের ছ্যাকা দিয়েছে, দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকিয়েছে,ঘুসি মেরেছে,আর ওসি গালে কয়েকটি থাপ্পর দিয়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে থানার বাহির ফেলে দিয়েছে

সেপ্টেম্বর ১৩ ২০১৯, ১৩:৪৬

Spread the love

অনলাইন ডেস্কঃবরিশালের উজিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিশির কুমার পালের বিরুদ্ধে সাবেক এক পুলিশ কর্মকর্তার বিধবা স্ত্রীকে থানার মধ্যে প্রকাশ্যে মারধর করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।এতে ওই বৃদ্ধার গালে রক্তাক্ত জখম এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে নীলাভ ফুলা ও জখমের সৃষ্টি হয়েছে।

একই সাথে রাশিদা বেগম (৬২) নামের ওই বৃদ্ধাকে মারধরের পর তার গালে সিগারেটের আগুনের ছ্যাকা দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ সদস্য জাহিদ। এ ঘটনার পরপরই নির্যাতনের শিকার ওই বৃদ্ধাকে থানা সংলগ্ন একটি চায়ের দোকানের সামনে চিৎকার করে কান্না করতে দেখা যায়।

খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক স্থানীয় সংবাদকর্মীরা সেখানে উপস্থিত হলে ওসির হাতে মারধরের শিকার বৃদ্ধা রাশিদা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, জাহিদ পুলিশ এই চায়ের দোকানে (থানা সংলগ্ন পশ্চিম পার্শ্বে বাচ্চুর দোকান) বসে আমার গালে সিগারেটের আগুনের ছ্যাকা দিয়ে পুড়িয়েছে। দেয়ালের সাথে আমার মাথা ঠুকিয়েছে। পিঠে ও ঘাঁড়ে ছয় থেকে সাতটি ঘুষি দিয়েছে। পাশের লোকজন ও দোকানদার না থাকলে আমাকে মেরেই ফেলতো। মারধরের সাথে আমার মা-বোন নিয়েও গালিগালাজ করেছে।

রাশিদা বেগম কাঁদতে কাঁদতে আরও বলেন, মার খেয়ে ওসির কাছে গেলাম ওসিও আবার মারলো। জাহিদ পুলিশের হাতে মারধরের শিকার হয়ে আমি সাথে সাথে থানার মধ্যে ওসি শিশির কুমার পালের রুমে গিয়ে বিষয়টি জানাই।

এ সময় সেখানে উপস্থিত থানার আরও একজন পুলিশ কর্মকর্তা ওসিকে বলে স্যার ঘটনাটি সত্য। এ কথা শোনার পরই ওসি শিশির চেয়ার থেকে উঠে আমাকে গালি দিয়েই বলে, ‘শালির ঝি শালি বের হ, এখানে আসছো কেনো।’ এরপর শুরু করে দুই গালে থাপ্পড়। একপর্যায়ে ওসি থাপ্পড় দিতে দিতে তার রুম থেকে বের করে দেয়।

তারপরও আবার বাইরে এসে আমাকে গলা ধাক্কাতে ধাক্কাতে থানার পশ্চিম পাশ্বের ব্রীজের গোড়ায় মাটিতে ফেলে দিয়েছে। এতে হাত-পায়ের অনেক স্থানের চামড়া উঠে গেছে।

কোন আক্রোশে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে জানতে চাইলে রাশিদা বেগম জানায়, তিনি মাদারীপুর সদর উপজেলার পানিচত্বর এলাকার বাসিন্দা। তার স্বামী মঈন উদ্দিন মাতবর একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। ১৬ বছর আগে তার স্বামী দায়িত্ব পালনকালে মারা যান। গত দেড় বছর আগে তার বড় ছেলের বউ খুন করে তার (বৃদ্ধ মহিলা) ছেলে রাসেল ও হাসানকে। দুই সহোদর ভাই পুত্রবধূর হাতে খুন হওয়ার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তিনি বরিশাল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) অফিসে দৌড়ঝাঁপ করতেছিল। প্রায় প্রতিদিন যাতায়াত করতে হতো পিবিআই অফিসে। এজন্য তিনি বরিশালের উজিরপুর উপজেলার ইচলাদী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন কালাম নামের এক ব্যক্তির ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। সেখানে তার সাথে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট মেয়ে (১১) বসবাস করতো।

নির্যাতিতা রাশিদা বেগম জানান, প্রায় এক মাস আগে মেয়েকে ওই ভাড়া বাসায় রেখে তিনি (রাশিদা) মামলার কাজে বরিশাল শহরে যান। এই সুযোগে ওই ভাড়া বাসা থেকে স্থানীয় শুক্কুর, বোরহান, আনিচ, কালামসহ বেশ কয়েকজন বখাটে মিলে তার মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

এ ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে উজিরপুর মডেল থানায় অভিযোগ করলে পুলিশ ২৪ দিন আগে তার মেয়েকে উদ্ধার করে। পরবর্তীতে পুলিশ সংবাদ দিয়ে তাকে থানায় ডেকে মেয়েকে বুঝিয়ে দেন। এ সময় বৃদ্ধা রাশিদা থানার ওসি শিশির কুমার পালকে বলেন, ‘দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। কিন্তু ওসি তাকে বলে আপনার মেয়ে পেয়েছেন আপনি চলে যান বিচার হয়ে গেছে।’

এমন পরিস্থিতে থানা থেকে মেয়েকে নিয়ে বৃদ্ধা রাশিদা বেগম বাসার উদ্দেশে রওনা দেন। পথিমধ্যে পূর্বের অভিযুক্তরাই আবার তার মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তখন পুনরায় থানায় গিয়ে ওসির কথানুযায়ী অভিযোগ লিখে জমা দেন। কিন্তু তাতেও কোনো সুফল না পেয়ে পরেরদিন নতুন করে আবার একটি অভিযোগ দিলে ওসি রাশিদা বেগমের সামনে অভিযোগ ছিঁড়ে ফেলে দেন।

রাশিদা বেগম ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, এভাবে তিনবার ওসির কাছে অভিযোগ দিয়েছি আর প্রত্যেকটি অভিযোগ ওসি তার সামনেই ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে ‘এসব নিয়ে সময় নষ্ট করা সম্ভব না।’ এদিকে মেয়েকে ছিনিয়ে নেওয়া ওইসব বখাটেদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দেয়ার পর অভিযুক্তদের স্বজনরা তার (রাশিদা) ভাড়া বাসায় তালা ঝুঁলিয়ে দেয়।

পরে উপায় না পেয়ে তিনি বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি মো. শফিকুল ইসলামের সাথে সাক্ষাৎ করে পুরো ঘটনাটি জানিয়ে ওসি শিশিরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক রেঞ্জ ডিআইজি উজিরপুর থানার ওসি শিশিরকে ফোন করে বৃদ্ধা রাশিদাকে আইনি সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি তার ভাড়া বাসা থেকে মালামাল উদ্ধারের কঠোর নির্দেশ প্রদান করেন।

রাশিদা বেগম আরও বলেন, ডিআইজি স্যারের কাছে যাওয়ার পরে ওসি বুধবার (১১ সেপ্টম্বর) সন্ধ্যায় আমাকে থানায় ডেকে আনে। সন্ধ্যায় আমি থানায় ওসির সাথে দেখা করতে রুমে গেলে তিনি বলেন, আপনি একটু পরে আসেন, আপাতত থানার বাহিরে চায়ের দোকানে গিয়ে বসেন। ওসির কথানুযায়ী রাশিদা তার রুম থেকে বের হতেই পুলিশ সদস্য জাহিদ তাকে বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান মাদারীপুর।

এরপর একটু সামনে এগিয়ে থানার পশ্চিম পাশ্বের গেটের কাছে আসলে বৃদ্ধা রাশিদাকে ওই পুলিশ সদস্য জাহিদ পুনরায় বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে একই উত্তর দেন। পরবর্তীতে থানার সামনের বাচ্চুর চায়ের দোকানে গিয়ে বসলে ওই পুলিশ সদস্য জাহিদ ফের রাশিদাকে বলে আপনার বাড়ি কোথায়, এখানে কী? এ সময় বৃদ্ধা রাশিদা রেগে গিয়ে জাহিদকে বলেন ‘কয়েকবার তো বললাম মাদারীপুর, শোনেননি?’ এরপরই পুলিশ সদস্য জাহিদ তাকে মারধর করে এবং একপর্যায়ে গালে সিগারেটের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে ওসির নিকট নালিশ দিতে গিয়ে পুনরায় মারধরের শিকার হন।

নির্যাতিতা রাশিদা বেগম ও তার ছেলে বাবু দাবি করেন, রেঞ্চ ডিআইজির কাছে ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় থানার ওসি শিশির কুমার পাল তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এ ঘটনায় তারা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

বৃদ্ধা রাশিদার ছেলে বাবু ওরফে আল-আমিন জানায়, তার মাকে মারধরের ঘটনায় অভিযুক্ত ওসি ও পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

অভিযুক্ত পুলিশ সদস্য মো. জাহিদুল ইসলাম বৃদ্ধা রাশিদাকে মারধরের বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করে জানান, ‘আমি বাচ্চুর দোকানে চা খেতে গিয়ে দেখি ওই মহিলা ওসি স্যারকে গালাগাল দিতেছে। তখন ওই মহিলাকে বাধা দিলে সে আমাকেও গালাগাল করে। এ সময় আমি তাকে সেখান থেকে তাড়ানোর জন্য মারধরের ভয় দেখিয়েছিলাম।’

উজিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিশির কুমার পালের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাচ্ছেন না জানিয়ে ফোনটি কেটে দেন।বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম জানান, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’উৎসঃপূর্বপশ্চিমবিডি

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও