শুধু বিশ্বাসের বলে একটা মসজিদের জমি মন্দিরের নামে হয়ে যেতে পারে নাঃভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায়

নভেম্বর ১১ ২০১৯, ০০:০১

Spread the love

আগমনী ডেস্কঃভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায় এর মন্তব্য যা আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তা ব্যাপক ভাবে আলোচিত হচ্ছে,’এই রায়টা কিসের ভিত্তিতে দেওয়া হল, সবটা ঠিক বুঝতে পারছি না। সুপ্রিম কোর্ট দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সেই আদালত একটা রায় দিলে তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাচ্ছি না।
চারশো-পাঁচশো বছর ধরে একটা মসজিদ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। সেই মসজিদকে আজ থেকে ২৭ বছর আগে ভেঙে দেওয়া হল বর্বরদের মতো আক্রমণ চালিয়ে। আর আজ দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলল, ওখানে এ বার মন্দির হবে।
ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ (এএসআই) জানিয়েছিল, ওই মসজিদের তলায় একটি প্রাচীনতর কাঠামোর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সেই প্রাচীনতর কাঠামো যে মন্দিরই ছিল, এমন কোনও প্রমাণ তো মেলেনি। সুপ্রিম কোর্ট নিজেও মেনে নিয়েছে যে, পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের রিপোর্টে কোনও ভাবেই প্রমাণ হচ্ছে না যে, একটা মন্দিরকে ভেঙে ওখানে মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল।
তা হলে কিসের ভিত্তিতে আজ মন্দির তৈরির নির্দেশ? বিশ্বাসের ভিত্তিতে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলল, অনেক হিন্দুর বিশ্বাস যে, ওখানে রামের জন্ম হয়েছিল। বিশ্বাস বা আস্থার মর্যাদা রাখতে ওই বিতর্কিত জমি রামলালা বিরাজমানের নামে দিয়ে দেওয়া হল। এটা কি আদৌ যুক্তিযুক্ত হল? রামচন্দ্র আদৌ ছিলেন কি না, কোথায় জন্মেছিলেন, সে সবের কোনও প্রামাণ্য নথি কি রয়েছে? নেই। রাম শুধু মহাকাব্যে রয়েছেন। সেই সূত্রে অনেক মানুষের মনে একটা বিশ্বাসও রয়েছে। কিন্তু সেই বিশ্বাসের বলে একটা মসজিদের জমি মন্দিরের নামে হয়ে যেতে পারে না। কালকে যদি আমি বলি, আপনার বাড়ির নীচে আমার একটা বাড়ি রয়েছে, এটা আমার বিশ্বাস, তা হলে কি আপনার বাড়িটা ভেঙে জমিটা আমাকে দিয়ে দেওয়া হবে?

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: এএফপিভারতের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: এএফপি

‘১০৪৫ পাতার রায়ে বিচারপতিদের যে সব পর্যবেক্ষণ সামনে এসেছে, তা থেকে কিন্তু মনে হচ্ছে না যে, সব যুক্তি ঝুঁকে রয়েছে কোনো একটি পক্ষের দিকে। সর্বোচ্চ আদালত কোথাও বলেছে, বাবরি মসজিদ কোনো ফাঁকা জমিতে তৈরি হয়নি, তার নিচে আরও প্রাচীন অমুসলিম স্থাপত্যের সন্ধান পেয়েছে পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ। আবার তার পরেই বলেছে, মসজিদের নিচে যে স্থাপত্য মিলেছে, তা হিন্দু স্থাপত্যও যদি হতো, তা হলেও ওই জমি হিন্দুদের হয়ে যায় না। তা হলে বিতর্কিত জমি কার? বিচারপতিরা রায়ে লিখেছেন, ১৮৫৭ সালের আগেও যে রামজন্মভূমিতে হিন্দু পুণ্যার্থীদের যাতায়াত ছিল। বিতর্কিত অংশের বাইরের চত্বরেও যে হিন্দুরাই পূজার্চনা করতেন, তা-ও স্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত বলে আদালত মনে করেছে। কিন্তু ১৮৫৭ আগে ওই অংশ সম্পূর্ণ ভাবে মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, এমন কোনো প্রমাণ সুন্নি ওয়াক্ফ বোর্ড দাখিল করতে পারেনি বলে আদালত মনে করছে।’

বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘ওয়াক্ফ বোর্ড শুধুমাত্র ওই প্রমাণটা দাখিল করতে পারল না বলেই কি জমির দখল রামলালা পেলেন? না, তেমন কোনো কথাও রায়ে লেখা নেই। বিতর্কিত জমির ওপরে রামলালা বিরাজমানের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নেপথ্যে বরং অন্য দু’টি কারণ সামনে আসছে। প্রথমত, বিতর্কিত জমিকে যে হিন্দুরা রামের জন্মস্থান হিসেবে বিশ্বাস করেন, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক বা বিরোধ নেই বলে আদালত মনে করেছে। আর দ্বিতীয়ত, বিতর্কিত জমিতে রামলালার অধিকার স্বীকার করে নেওয়াটা আইন-শৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বহাল রাখার প্রশ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে বিচারপতিরা মনে করেছেন।’

ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করা তো আদালতের কাজ নয়। আদালত সিদ্ধান্তে পৌঁছয় অকাট্য প্রমাণ এবং প্রামাণ্য নথিপত্রের ভিত্তিতে। বাবরি মসজিদ যেখানে ছিল, সেই জমিতে মন্দির তৈরির নির্দেশ সুপ্রিম কোর্ট কোন অকাট্য প্রমাণ ও প্রামাণ্য নথির ভিত্তিতে দিল, সেটা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়েছে। বাবরি মসজিদ যে ওখানে ছিল, পাঁচ শতাব্দী ধরে ছিল, সে আমরা সবাই জানি। বাবরি মসজিদ যে গুন্ডামি করে ভেঙে দেওয়া হল, সেটাও আমরা দেখেছি। এমনকি সুপ্রিম কোর্ট এ দিনের রায়েও মেনে নিয়েছে যে, অন্যায় ভাবে মসজিদটা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৫২৮ সালের আগে ওখানে রাম মন্দির ছিল কি না, আমরা কেউ কি নিশ্চিত ভাবে জানি? রাম মন্দির ভেঙেই বাবরি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল, এমন কোনও অকাট্য প্রমাণ কি কেউ দাখিল করতে পেরেছিলেন? পারেননি। তা সত্ত্বেও যে নির্দেশটা শীর্ষ আদালত থেকে এল, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক নয় কি?

ছবি: রয়টার্সছবি: রয়টার্স

ভারতের অযোধ্যার আলোচিত বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি মামলার রায়ে মসজিদ নির্মাণে সরকারকে অন্যত্র পাঁচ একর জমি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। আদালতের রায়ে বলা হয়, মসজিদের নিচে স্থাপনা থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এটি মন্দির কি না, তা নিশ্চিত নয়।

২ দশমিক ৭৭ একর বিরোধপূর্ণ জমিতে মন্দিরের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে ট্রাস্ট গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। ওই জমিতেই বাবরি মসজিদ ছিল।

হিন্দুত্ববাদীদের বিশ্বাস, উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় ভগবান রামচন্দ্র জন্মেছিলেন। তাঁর জন্মস্থান বলে চিহ্নিত জায়গায় ষোড়শ শতকে মোগল সম্রাট বাবরের আমলে একটি মসজিদ তৈরি হয়। নাম দেওয়া হয় বাবরি মসজিদ। মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি নিয়ে সেই থেকে হিন্দু-মুসলিম যে বিরোধ চলছিল, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর তা অন্যদিকে বাঁক নেয়। ওই দিন কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেন। এ নিয়ে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অন্তত দুই হাজার লোক নিহত হয়। সেই থেকে বাবরি মসজিদের ২ দশমিক ৭৭ একর জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধিতা শুরু হয়। এলাহাবাদ হাইকোর্ট ওই জমি বিবদমান তিন পক্ষ রাম লালা, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড ও নির্মোহী আখড়ার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করার নির্দেশ দেন। তবে সেই নির্দেশ চ্যালেঞ্জ হয় সুপ্রিম কোর্টে।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, মসজিদটি ফাঁকা জায়গায় নির্মাণ হয়নি। এর নিচে অন্য কাঠামো ছিল। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার খননের ফলে যেসব জিনিস পাওয়া গেছে, এতে বোঝা গেছে সেগুলো ইসলামি নয়। অযোধ্যায় বিকল্প স্থানে মসজিদ নির্মাণের জন্য পাঁচ একর জমি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। মন্দিরের জন্য সরকারকে ট্রাস্ট গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিন মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারকে এ ট্রাস্ট গঠন করতে হবে। বিরোধপূর্ণ জমি চলে যাবে ট্রাস্টের কাছে।
রায়ে বলা হয়, বাবরি মসজিদ ভাঙার মধ্য দিয়ে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে।

প্রথমত, বিতর্কিত জমিকে যে হিন্দুরা রামের জন্মস্থান হিসেবে বিশ্বাস করেন, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক বা বিরোধ নেই বলে আদালত মনে করেছে। আর দ্বিতীয়ত, বিতর্কিত জমিতে রামলালার অধিকার স্বীকার করে নেওয়াটা আইন-শৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বহাল রাখার প্রশ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে বিচারপতিরা মনে করেছেন।’

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও