নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ড্যান্সের আড়ালে নারী পাচার ব্যবসা রমরমা
নজরুল ইসলাম লিখন, রূপগঞ্জঃ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে নারী প্রাচারকারী চক্ররা বিভিন্ন পন্থায় সক্রিয় রয়েছে। নাচের ব্যবসার আড়ালে এক দল অসাধু শিল্পীকর্মী নারীদেরকে পণ্য বানিয়ে বিভিন্ন দেশে পাচার কওে দিচ্ছে। রূপগঞ্জের ক্রাইমজোন খ্যাত চনপাড়া এলাকাতেই রয়েছে এমন ১১ সক্রিয় চক্র। চনপাড়ার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেয়ে শাম্মী (ছদ্মনাম}। নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। মা-বাবার কষ্টের সংসারে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো শাম্মী। হঠ্যাৎ একদিন পাশের তারাব পৌরসভার সম্পর্কে এক দুলাভাই তাকে ড্যান্স শেখার প্রস্তাব দেয়। লোভ দেখায় ড্যান্স শিখলে দেশের বাহিরে যাওয়া যাবে। মাসে মোটা অংকের মাইনে পাওয়া যাবে। যেমন প্রস্তাব, তেমন প্রস্তুতি।
ড্যান্স শেখার পর শাম্মীকে দুবাই পাঠানো হলো। টানা তিন মাস থাকার পর শাম্মী বুঝতে পারলো আসলে ড্যান্সের আড়ালে তাকে কি করতে হয়? সুযোগ বুঝে দেশের মাটিতে চলে আসে সে। তার ভাষায়, ‘এই কামে যেন কেউ না যায়।’ শুধু শাম্মী নয়। ড্যান্সের আড়ালে রূপগঞ্জ থেকে গত ৫ বছরে প্রায় ৬৫০ জন নারী আরব আমিরাত, দুবাই, শারজা, বেঙ্গালুরে পাচার হয়েছে। এই ৬৫০ জন নারীর মধ্যে চনপাড়া পূর্নবাসনের রয়েছে অনেকে। নোয়াপাড়ার বিশাল-সাব্বির হোসেন, ডেমরা ষ্টাফ কোয়ার্টারের রেশমা বেগম আর চনপাড়া পূর্নবাসনের সোহানা বেগমসহ রূপগঞ্জে প্রায় ১১ নারী পাচারকারী চক্রের সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডেরা দুবাই, বার দুবাই, আবুধাবি, শারজাহ, ফুজাইরা ও রাস আল খাইমায় অন্তত ৩০-৩৫টি বাঙালি ড্যান্স বার রয়েছে। রূপগঞ্জ থেকে পাঠানো তরুণীদের মূলত এসব বাঙালি বারে কাজ করতে নেওয়া হয়। এদের প্রধান লক্ষ্য নিম্নবিত্ত পরিবারের তরুণীরা। তাঁদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে সেখানে নিয়ে যৌন পেশায়ও বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত কয়েক বছরে রূপগঞ্জ থেকে নারী পাচারচক্রের ৮ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এসময় পাচারের শিকার হওয়া ৪ তরুণীকে উদ্ধারও করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ চক্রটি দরিদ্র পরিবারের তরুনীদের খুঁজে বের করে। পরে রাজধানীর নাচের স্কুলে (ড্যান্স স্কুল) নাচ শিখিয়ে পাচার করে দেয়। তাঁরা একেকজন তরুণীকে বিদেশ যেতে রাজি করানো বাবদ ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পান আরব আমিরাতে থাকা মূল চক্রের কাছ থেকে। তরুণীদের মূলত তিন থেকে ছয় মাসের পর্যটক ভিসায় পাঠানো হয়। তরুণীদের সংগ্রহ, পাসপোর্ট করানো, ভিসা সংগ্রহ, বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পার করানো এবং আরব আমিরাতে ‘ড্যান্স বারে’ পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সবখানে এই চক্রের লোক রয়েছে। বারে নৃত্য করার নাম করে নেওয়া হলেও এঁদের অনেককে যৌন পেশায় বাধ্য করানোর অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরব আমিরাতে এভাবে গিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন, এমন বেশ কয়েকজন তরুণীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেছেন, পরিবারে আর্থিক অনটন রয়েছে, অল্প বয়সে বিয়ের পর তালাক হয়েছে এবং পোশাক কারখানায় কাজ করেন এমন মেয়েরা সবচেয়ে বেশি এসব পাচারকারীর খপ্পরে পড়ছেন। গত ৫ বছরে অন্তত ৬৫০ মেয়েকে এভাবে তিন মাসের পর্যটক ভিসায় আরব আমিরাতের ড্যান্স বারে গিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এর মধ্যে একই তরুণী একাধিকবারও গেছেন, এমনও আছে।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে জানা গেছে, বিগত ২০১৯ সালের গত ২৩ নভেম্বর শনিবার রাতে রূপগঞ্জ উপজেলার তারাব পৌরসভার শাহ চন্দ্রপুরী রেস্তোরাঁ থেকে পাচারের উদ্দেশ্যে একত্র করার সময় নারী পাচারকারীদের হাত থেকে চার তরুণীকে উদ্ধার করে র্যাব-১১। ঐ সময় আটক করা হয়েছে নারী পাচারকারী চক্রের ছয় সদস্যকে। আটক ছয়জন হলেন ময়মনসিংহের ধোবাউড়া এলাকার অনিক হোসেন, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার আক্তার হোসেন, পাসপোর্ট প্রস্তুতকারী দালাল চাঁদপুরের কচুয়ার আফতাউল ইসলাম ওরফে পারভেজ, দুবাইয়ে ড্যান্স ক্লাবের মালিক নোয়াখালীর চাটখিল এলাকার মনির হোসেন ওরফে সোহাগ, কুমিল্লার চান্দিনা এলাকার আবদুল হান্নান ও ‘মুবিন এয়ার’ ট্রাভেল এজেন্সির মালিক মো. আকাশ।
এছাড়া ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর বরপা কেরামবোর্ড এলাকা থেকে নারী পাচারকারী চক্রের সদস্য রহিমা বেগমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিগত ২০১৫ সালের ১০ আগষ্ট চনপাড়া পূর্নবাসন কেন্দ্র থেকে নারী পাচারকারী চক্রের সদস্য হাসিনা বেগমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৭০ তরুণীর পাসপোর্ট, ১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা, ২০০টি পাসপোর্টের ফটোকপি, ৫০টি বিমান টিকিট, ৫০টি ট্যুরিস্ট ভিসার ফটোকপি, ১টি সিপিইউ, ১টি মনিটর ও ১টি অত্যাধুনিক বিলাসবহুল মাইক্রোবাস।
সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ফিরে আসা কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাঁদের বয়স ১৮ থেকে ২৩ বছরের মধ্যে। এদের অনেকেই থাকেন চনপাড়া পূর্নবাসনে। সংগত কারণে পরিচয় প্রকাশ করা যাচ্ছে না। রূপগঞ্জের চনপাড়া পূর্নবাসন কেন্দ্র থেকে যাওয়া ১৭ বছরের এক তরুণী (ফেরত এসেছেন}এই কাজে যুক্ত হওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, তাকে ডান্স ক্লাবে কাজ দেওয়ার নাম করে দুবাই পাঠায়। সেখানে যাওয়ার পর সে অন্য চিত্র দেখতে পায়। তারপর সুযোগ বুঝে চলে আসে। ২১ বছর বয়সী আরেক তরুণী জানান, প্রথমে ৫০ হাজার টাকা দেয় পার্টি। পরে দুবাই পাঠায়। সেখানে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। বাধ্য হয়ে ফিরে আসি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘ড্যান্স বারে’ কাজ করে দেশে ফিরে আসা কয়েকজন তরুণীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরব আমিরাতে যাওয়ার বিষয়টি কয়েক ধাপে সম্পন্ন হয়। যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে দেশে থাকা এজেন্টরা মেয়েদের ছবি ‘ড্যান্স বারের’ মালিকদের কাছে পাঠান। সেখান থেকে পছন্দ করলে তাঁদের পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। কখনো কখনো নতুন মেয়েদের দেখতে বার মালিকেরা তাঁদের প্রতিনিধিকে এ দেশে পাঠান। এরপর তাঁদের পাসপোর্ট করে দেওয়া হয়।
তিন মাস থেকে ফিরে আসা এক তরুণী জানান, আরব আমিরাতে যাওয়া-আসার পুরো খরচ বহন করেন ‘ড্যান্স বারের’ মালিকেরা। যাওয়ার আগে তাদের অগ্রিম ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। পৌঁছানোর পর তাদের একটি কক্ষে রাখা হয়। প্রতি কক্ষে ১০-১২ জন থাকেন। থাকা-খাওয়ার খরচ ‘ড্যান্স বারের’ মালিক বহন করেন।
আরেক তরুণী জানান, বাসা থেকে ‘ড্যান্স বারে’ তাঁদের গাড়িতে করে নেওয়া হয়। রাত নয়টা থেকে তিনটা পর্যন্ত বারের ‘ড্যান্স ফ্লোরে’ তাঁদের নাচতে হয়। কাজ শেষে আবার গাড়িতে করে বাসায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বাসায় তাঁদের তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। বাসা ও ড্যান্স বারের বাইরে আর কোথাও তাঁদের যাওয়ার সুযোগ নেই। কদাচিৎ তাঁদের বাইরে ঘুরতে নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন তরুণী বলেন, ড্যান্স বারে কাজ করে ফিরে আসা এক তরুণীরা জানান, আরব আমিরাতের বাঙালি ড্যান্স বারগুলোতে খদ্দরদের বড় অংশই প্রবাসী বাঙালি। বারের সবকিছু চলে টোকেনের ভিত্তিতে। বারে ঢুকতে ৫০ দিরহাম (প্রায় ১১৫০ টাকা) দিয়ে টোকেন কিনতে হয়। সেবাগ্রহীতা পছন্দের কোনো তরুণীকে নাচতে বললে সে জন্য ওই তরুণীকে টোকেন দিতে হয়। প্রতি টোকেনের দাম ৫০ দিরহাম। বারের মালিকের প্রতিনিধি সেই টোকেনগুলো সংগ্রহ করেন এবং সংশ্লিষ্ট তরুণীর নামের পাশে সংখ্যা লিখে রাখেন। প্রতি তরুণীর মাসিক বেতন ধরা হয় ৫০ হাজার টাকা। আর এই বেতন পেতে হলে তাঁকে সেবা গ্রহীতাদের কাছ থেকে মাসে কমপক্ষে তিনশটি টোকেন পেতে হয়, যা বাংলাদেশি টাকায় তিন লাখ ৪৫ হাজার টাকার মতো। কোনো মেয়ে যদি ৩০০ টোকেনের বেশি সংগ্রহ করতে পারেন, তাহলে আনুপাতিক হারে তাঁর বেতনও বাড়ে। ৩০০ টোকেনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে ওই মাসের বেতন দেওয়া হয় না।
ভুক্তভোগী কয়েক তরুণী জানান, ড্যান্স বারে কাজ করার প্রথম শর্ত হলো চেহারা ভালো হতে হবে। অনেক মেয়েই ঠিকমতো নাচ পারেন না। তাঁরা মাসে ৩০০ টোকেনও সংগ্রহ করতে পারেন না। তখন ‘ড্যান্স বারের’ মালিকেরা তাঁদের জোর করে সেবাগ্রহীতার সঙ্গে বাইরে পাঠান। আর সেবাগ্রহীতারা তখন ২০ থেকে ৩০টি টোকেন ড্যান্স বারের মালিকের কাছ থেকে কিনে নেন।
রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ এ এফ এম সায়েদ বলেন, আমি সবেমাত্র রূপগঞ্জ থানায় জয়েন করেছি। এ ব্যাপারে অবগত নই। তবে বিষয়টি নিয়ে দেখবো। রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ নুসরাত জাহান বলেন, আমার জানা নেই। হয়তো থানায় মামলা হয়ে থাকলে নথি থাকবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিবো।