তখনই প্রতিজ্ঞা করি রাষ্ট্রভাষা বাংলা না করে ঘরে ফিরবো না-ভাষা সৈনিক ইউসুফ কালু

ফেব্রুয়ারি ২০ ২০২১, ২১:৩১

Spread the love

নাঈম ইসলাম:

দিনটি ছিল স্বাভাবিক দিনের মতোই।১৯৪৮ সালে তখন বরিশাল বিএম স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র।ঘোষণা দেয়া হয়েছিল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।তখনই বাংলাদেশের মানুষ ফুঁসে উঠে, প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে প্রানের ভাষা রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি জানায়। সারাদেশের ন্যায় বরিশালেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দল-মত নির্বিশেষে শিক্ষক-ছাত্র দিনমজুরসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিবাদ জানায়। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র।আমাদের বি.এম স্কুল গেটের সামনে থেকে একটি মিছিল “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” স্লোগান দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সামনের দিকে।বাংলা ভাষা রক্ষায়,বাংলা ভাষার দাবিতে তখন কোনো কিছু না ভেবেই যোগ দেই মিছিলে।বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আমার আন্দোলনের সূচনা তখন থেকেই।মিছিলে যোগদেই আর শ্লোগান দিতে দিতে বরিশাল কলেজের সামনে এসে যাই। তখন সবার একটাই স্লোগান “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”বরিশাল কলেজ থেকে একটু সামনে আগালেই পুলিশের ত্রিমুখী হামলায় পরি আমরা।শুরু হয় আমাদের ওপর লাঠিচার্জ আর ধরপাকড়। লাঠিপেটা খেয়ে তখন কোনো রকম বাসায় এসে পৌছাই। এরপরই রাষ্ট্র ভাষা বাংলাকে প্রাণের দাবি মনে করে আর পিছু হেটে যাইনি। বরং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি পূরণ না করে ঘরে ফিরবো না বলে প্রতিজ্ঞা করি। তখন থেকেই ভাষা আন্দোলনের সকল কর্মসূচি গুলোতে যোগ দিতে শুরু করি।ঐ বছরই কাজী বাহাউদ্দিন এর সভাপতিত্বে ফকির বাড়ি রোডের একটি আলোচনা সভায় যোগ দেই।১৯৪৮ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্নভাবে বিক্ষোভ মিছিলসহ আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাই। আর আন্দোলনের আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ দিতে বড় বড় কাগজে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই লিখে পোষ্টার বানিয়ে সড়কের ওয়ালে ওয়ালে লাগাই।পোস্টার লাগাতে গিয়ে আমাদের ভাষা আন্দোলনকারী মজিবুর রহমান কাঞ্চন পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হন। তারপরেও পাকিস্তান স্বৈর শাসকদের টনক নড়েনি বরং ১৯৫০সালে হিন্দুদের উপর হামলা চালানো হয়। ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেক হিন্দু পাড়ি জমিয়েছিলেন ভারতে।১৯৫১ সালে ভাষা আন্দোলনের মাত্রা আরো তীব্রতর হয়।সমস্ত বাঙালির তখন প্রাণের দাবি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। আমি তখন এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র। আন্দোলন যখন একেবারে ঢাকা থেকে শুরু করে গ্রাম পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে তখন পাকিস্তানি শাসকরা পড়ে যায় দুশ্চিন্তায়।ভাষা আন্দোলন আরো বেগবান করার জন্য ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে ভাষা সংগ্রাম কমিটি হয়েছিল।বরিশালেও হয়েছিল ৮১ সদস্য বিশিষ্ট ভাষা সংগ্রাম কমিটি ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তানী প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেন। সারাদেশে মিছিল-মিটিং করা যাবে না। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বরিশালে মিছিল বের করি আমারা। তখন তো তেমন একটা যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রযুক্তিগত কোন সুবিধা ছিল না। ঢাকার খবর আমাদের রেডিওতে শুনতে পেতে সন্ধ্যা হত।আমরা সন্ধায় রেডিওতে খবর শুনি ঢাকার মিছিলে গুলি চালানো হয়েছে।এতে শহীদ হয়েছে অনেকে।২২ তারিখ থেকে আরো আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাই।তখন শহীদদের বিচার আর রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে এভাবেই চলতে থাকে আমাদের আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি পুরন করেই ঘরে ফিরেছি আমরা।এক সন্তান আর এক স্ত্রী নিয়ে নগরীর বগুরা রোডে বীর ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ ইউসুফ মিয়ার বসবাস।৮৭ বছরের সূর্যসন্তান ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ ইউসুফ কালুর দেশের প্রতি কি চাওয়া জানতে চাইলে জানায়,আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, মায়ের এ ভাষা রক্ষায় জীবনকে বাজি রেখেছি রক্ত দিয়ে ভাষা উদ্ধার করেছি। বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার বাংলা ভাষার চর্চা সকলের মধ্যে থাকা উচিত।দেশের প্রতি চাওয়া, দেশের সরকারের প্রতি চাওয়া ভাষা সৈনিকদের সরকারি সুবিধা দেয়া হয় না। সরকারিভাবে যদি সহায়তা বা প্রত্যক্ষভাবে সরকার আমাদের পাশে দাঁড়াতো তাহলে শেষ সময়ে তৃপ্তি নিয়ে শেষ জীবনটা কাটিয়ে যেতে পারতাম। আরেকটা কথা প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে একুশে পদক দেয়া হয়। সেখানে সরকার বা আয়োজকদের উচিত সারাদেশের জীবিত ভাষা সৈনিকদের উপস্থিত রাখা। নতুন প্রজন্মের প্রতি কি উপদেশ জানতে চাইলে এ ভাষা সৈনিক বলেন, নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষা ব্যবহারে বা বাংলা সংস্কৃতি এড়িয়ে চলছেন। বাংলা ভাষা রক্ষায় কতটা ত্যাগ কতটা রক্ত আমাদের দিতে হয়েছে তার গুরুত্বটা বুঝতে হবে তাদের।এছারাও বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহারে সচেতন সহ বাংলা ভাষার উপর মায়া বা ভালোবাসাটা একান্ত প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও