বিএসটিআইয়ের আইনজীবীকে উচ্চআদালতের তিরস্কার,চার ল্যাবের পরীক্ষায়ও পাস্তুরিত দুধে ক্ষতিকর জীবাণু,প্রাণসহ ১০ কোম্পানির বিরুদ্ধে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মামলা

জুলাই ২৫ ২০১৯, ১৩:১৬

Spread the love
হাইকোর্টের নির্দেশনায় পাস্তুরিত দুধের ১০টি নমুনা পরীক্ষা করে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের ল্যাবরেটরি (বিসিএসআইআর, সায়েন্স ল্যাব), আইসিডিডিআরবির ল্যাবরেটরি, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউট (সাভার) ও জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি।

প্রাণসহ ১০টি কোম্পানির দুধে ক্ষতিকর জীবাণু পাওয়ায়  নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে গত বুধবার মামলা করেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পরিদর্শক মো. কামরুল হাসান।

পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রাণসহ ১০টি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধের ভেজাল পাওয়ায় এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। কোম্পানিগুলো হচ্ছে- প্রাণ মিল্ক, মিল্কভিটা, ডেইরি ফ্রেশ, ইগলু, ফার্ম ফ্রেশ, আফতাব মিল্ক, আল্ট্রা মিল্ক, আড়ং ডেইরি, পিউরা ও সেইফ মিল্ক।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের সদ্য সাবেক পরিচালক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বেসরকারি চ্যানেল যমুনা টিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানের পাস্তুরাইজেশন ইউনিট আছে। কিন্তু তারা ব্যবহার করছে না। এগুলোকে ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না।

তার মানে ভোক্তাদের প্রতি অবহেলার বিষয় বারবার প্রমাণিত হচ্ছে।  অত্যন্ত নোংরা জায়গায় যে জীবাণুগুলো থাকে সেগুলোই দুধের মধ্যে পাওয়া যেত না। এটা কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, গবেষণার তথ্য প্রকাশের পর অনেক ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে কথা শুনতে বাধ্য হয়েছি। এতদিন তারা (দুধ উৎপাদনকারী) বলে এসেছে, আমাদের গবেষণা ভুয়া।

আমরা গবেষণা জানি না। যন্ত্রপাতি ঠিক ছিল না। যন্ত্রপাতি অ্যাক্রিডিটেড কিনা? আজকে দেখা গেছে, আমাদের গবেষণা সঠিক ছিল। তিনি আরও বলেন, উন্নত বিশ্বের মতো ভোক্তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার মতো বিষয় বিবেচনায় আনা উচিত।

অনুমোদিত ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত দুধে অ্যান্টিবায়োটিক ও ডিটারজেন্টসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান আছে কিনা, সে বিষয়ে চারটি প্রতিষ্ঠানের ল্যাবের পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেয়েছে বিএসটিআই।

বুধবার বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে ২৮ জুলাই পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।

এ প্রতিবেদনগুলো হলফনামা আকারে দাখিল এবং দাখিলের পর রিটকারী পক্ষ এগুলো দেখতে সময় চেয়ে আবেদনের পর শুনানি মুলতবি করেন আদালত।

বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেন। ওই দিনই (২৮ জুলাই) এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। বিএসটিআইয়ের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার সরকার এমআর হাসান। রিট আবেদনকারীপক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার অনিক আর হক।

বুধবার সকালের মধ্যে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের ল্যাবরেটরি (সায়েন্স ল্যাব), আইসিডিডিআরবির ল্যাবরেটরি এবং বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউটের (সাভার) ল্যাবরেটরি প্রতিবেদন আদালতে এফিডেভিট আকারে দাখিল করার জন্য বিএসটিআইয়ের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।

বিএসটিআইয়ের আইনজীবী ব্যারিস্টার সরকার এমআর হাসান আদালতকে জানান, জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। এটা এফিডেভিটের জন্য সময় চাচ্ছি। এ সময় রিট আবেদনকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার অনিক আর হক বলেন, চারটি ল্যাবের প্রতিবেদন দেখতে সময় দরকার। এজন্য সময় চাচ্ছি। এ সময় আদালত আগামী রোববার পরবর্তী শুনানি ও আদেশের জন্য দিন ধার্য করেন। আদালত এ সময়ের মধ্যে ল্যাবের প্রতিবেদন এফিডেভিট আকারে দাখিল করতে বিএসটিআইকে নির্দেশ দেন।

মঙ্গলবার বিএসটিআই জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির প্রতিবেদন ছাড়া অপর তিনটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন আদালতকে দেখতে দেন। আদালত রিপোর্টগুলো দেখার পর মূল কপি বিএসটিআইর আইনজীবীকে ফেরত দেন। একসেট ফটোকপি নিজেদের কাছে রেখে দেন আদালত।

আদালত বলেন, এই প্রতিবেদন আপাতত আমাদের, আপনাদের (বিএসটিআই ও রিট আবেদনকারীপক্ষের আইনজীবী) মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক। হলফনামা আকারে প্রতিবেদন দাখিল করার পর দেখা যাবে।

এ কারণে পরীক্ষা প্রতিবেদনে কী পাওয়া গেছে সে বিষয়ে কোনো আইনজীবী গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেননি। রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ মে এক আদেশে বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের নিয়ে কমিটি গঠন করে বাজারে থাকা পাস্তুরিত দুধ পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সচিব এবং বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এই নির্দেশের পর গত ২৫ জুন বিএসটিআইয়ের আইনজীবী আদালতে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।

কিন্তু কোনো শুনানির আগেই সেদিন তিনি গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘চৌদ্দটি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধে আশঙ্কাজনক বা ক্ষতিকর কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি।

এই প্রতিবেদনে আদালত সন্তোষ প্রকাশ করেন, সংস্থার আইনজীবীর এমন বক্তব্যে গত ৯ জুলাই হাইকোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

এই বক্তব্যের কারণে বিএসটিআইয়ের আইনজীবীকে তিরস্কার করেছেন উচ্চ আদালত। একই সঙ্গে আদালতের আদেশ ছাড়া দুধ নিয়ে কোনো বিভ্রান্তিকর তথ্য ও বিজ্ঞাপন প্রচার না করতে মৌখিকভাবে নির্দেশ দেন। আদালত বলেন, দুধ পরীক্ষার প্রতিবেদন নিয়ে আমরা কোনো আদেশ দেইনি, মতামতও প্রকাশ করিনি।

অথচ আপনি মিডিয়ার সামনে আদালতের সন্তোষ প্রকাশের কথা বললেন। আর আপনার এই বক্তব্যের পর গণমাধ্যমে প্রাণ গ্রুপ হাইকোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে তাদের পণ্যের গুণগান প্রচার করছে।

এই দুধ খেয়ে যদি কেউ অসুস্থ হয়, তার দায় কে নেবে?’ আদালত বলেন, যে প্রতিবেদনে কোনো শুনানিই হল না, আদালত কোনো আদেশ দিল না। তারপরও আদালতকে জড়িয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার হল।

গত ২৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদ ও বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করে যে বাজারে প্রচলিত সাতটি পাস্তুরিত ও তিনটি অপাস্তুরিত দুধের নমুনা সংগ্রহ করে তারা বিএসটিআইয়ের মান অনুযায়ী পরীক্ষা করেছে। পাস্তুরিত দুধের সাতটি নমুনায় বিএসটিআই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ‘ফ্যাট ইন মিল্ক’ ৩.৫ শতাংশ থাকার কথা থাকলেও এগুলোতে আছে ৩.৬ থেকে ৩.৬১ শতাংশ।

এসব দুধে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। পাস্তুরিত দুধের সব কটিতে মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক লেভোফ্লক্সাসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও এজিথ্রোমাইসিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া রয়েছে ফরমালিন ও ডিটারজেন্টের উপস্থিতি।

দুধের ব্র্যান্ডগুলো হল- প্রাণ, মিল্কভিটা, আড়ং, ফার্ম ফ্রেশ, ইগলু, ইগলু চকোলেট এবং ইগলু ম্যাংগো।

অপাস্তুরিত (খোলা) দুধের তিনটি নমুনা রাজধানীর পলাশী, গাবতলী ও মোহাম্মদপুর বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এদিকে দ্বিতীয় দফার পরীক্ষাতেও প্রাণমিল্কসহ ৫ কোম্পানির সাতটি পাস্তুরিত দুধে মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক।

অপাস্তুরিত তিন দুধেও প্রায় একই ধরনের উপাদান পাওয়া গেছে।

এই বিভাগের আরো খবর


আরো সংবাদ ... আরও